টানা ১২ বছর গোলকধাঁধায় আটকে ছিলেন বাস্তবের ড্রাকুলা

Odd বাংলা ডেস্ক: ড্রাকুলার নামটি শুনলে যে কারোরই মেরুদণ্ড বেয়ে একটি ঠাণ্ডা শিহরন বয়ে যায়। ব্রাম স্টকারের কাউন্ট ড্রাকুলার এই চরিত্রটির সঙ্গে পরিচিত নন এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টের। ১৮৯৭ সালে লেখা তার এই বইয়ের অনুপ্রেরণায় একাধিক ছবি, অনুষ্ঠান, ভ্যাম্পায়ার বা রক্তচোষাদের নিয়ে কাহিনী তৈরি হয়েছে।

পাঠক এবং দর্শকদের মনে কাউন্ট ড্রাকুলার কাহিনী একেবারে গেঁথে গিয়েছে। যদিও এই কাউন্ট ড্রাকুলা পুরোটাই ছিল লেখকের কল্পনা। তবে ব্রাম স্টকার তার উপন্যাসের চরিত্রের নামকরণ করেছিলেন বাস্তবের ড্রাকুলা নামানুসারেই। বাস্তবের কাউন্ট ড্রাকুলার কথা জানেন তো? ভ্লাদ দ্য ইম্পালার। রোমের এক ঐতিহাসিক অঞ্চল ওয়ালাসিয়া। তারই যুবরাজ ছিলেন ভ্লাদ দ্য ইম্পালার কিংবা তৃতীয় ভ্লাদ। এই যুবরাজেরই অপর নাম ছিল ড্রাকুলা। 

যদিও ওই নামটি ছাড়া কাহিনীর ড্রাকুলা এবং ওয়ালাসিয়া যুবরাজের আর কোনো চারিত্রিক মিল নেই। ইতিহাসবিদদের মতে, উপন্যাসটি লেখার আগে ওয়ালাসিয়াতে এসেছিলেন ব্রাম। সেখান থেকেই ড্রাকুলা শব্দটি নেন তিনি। 

তবে ওয়ালাসিয়া যুবরাজ ড্রাকুলা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ব্রামের কাউন্ট ড্রাকুলা ট্রানসিলভ্যানিয়ার বাসিন্দা। সেখানে তার দূর্গ দেখতে আজও পর্যটকেরা ভিড় জমান। যদিও ট্রানসিলভ্যানিয়ার সঙ্গে তৃতীয় ভ্লাদের কোনো যোগসূত্র নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবনে কোনো দিন সেখানে থাকেনওনি তিনি।

তৃতীয় ভ্লাদের বাবা ছিলেন দ্বিতীয় ভ্লাদ। ১৪৩১ সালে হাঙ্গেরির রাজা ড্রাগনের নির্দেশে তাকে ড্রাকুল হিসেবে ডাকা শুরু হয়। ড্রাগন থেকে ড্রাকুল কথাটি এসেছিল। ড্রাকুল অর্থাৎ শয়তান। অত্যাচারী রাজা হওয়ার জন্যই তাকে এই নাম দেয়া হয়েছিল। তার ছেলে তৃতীয় ভ্লাদ সে কারণে ছিলেন ‘ড্রাকুলের সন্তান’। আদি রোম ভাষায় যা ড্রাকুলি অর্থাৎ ড্রাকুলা।

হাঙ্গেরি এবং ওয়ালাসিয়া ছিল পাশাপাশি দুটো রাজ্য। ১৪৪২ সালে ওয়ালাসিয়াতে অটোমান সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। তাদের হাত থেকে রাজত্বের সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়। হাঙ্গেরির সঙ্গে চুক্তি করে ওয়ালাসিয়া আক্রমণ করেন দ্বিতীয় ভ্লাদিস্লাভ। ওয়ালাসিয়া জয় করে সিংহাসনে বসেন দ্বিতীয় ভ্লাদিস্লাভ। প্রকৃতপক্ষে মুখগহ্বরের দু’পাশে অতিকায় দু’টি ক্যানাইন কিংবা রক্তের প্রতি আসক্তি কোনোটাই তার ছিল না। তবে তিনি ছিলেন খুবই অত্যাচারী।

গর্ভবতী কোনো নারীও নিস্তার পেত না তার নির্মমতা থেকে। তাদের শূলে চড়ানো হতো তলপেটের ওপর দিয়ে, যেনো পেটের বাচ্চাটার ওপর দিয়ে আঘাতটা আগে যায়। একবার তো নিজের শহর ট্রানসিলভানিয়ারই সব হতদরিদ্র এবং পঙ্গু মানুষকে তিনি আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলেন। কারণ তিনি চাননি তার শহরে কোনো দরিদ্র লোক থাকুক। কারো কারো মতে, তার ছিল মৃতদেহে আসক্তি। প্রেমে প্রতারণাকারী এক নারীকে হত্যা করে দিনের পর দিন তিনি নাকি সেই নারীর মৃতদেহের সঙ্গেই বাস করে গেছেন!

এই শাসকের অত্যাচারের ছিল খুবই নিষ্ঠুর। আচরণ নিয়ে জনশ্রুতিরও অভাব নেই। মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত মানুষটির দুই পা ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে ছড়িয়ে রাখা হতো। এরপর লম্বা কাঠের শূল তার পায়ু পথ দিয়ে ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বের করে আনার চেষ্টা করা হতো। ইচ্ছে করে শূলটাকে রাখা হতো ভোঁতা করে, যেনো তা মানুষটার শরীরে প্রবেশ করতে অনেক সময় নেয় এবং সে তিলেতিলে যন্ত্রণা ভোগ করে মরে!এভাবে শাস্তি দেয়াটা রীতিমত বিকৃত রুচির পরিচায়ক। তার অন্যান্য শাস্তির মধ্যে ছিল অপরাধীর মাথা পাথর দিয়ে থেঁতলে ফেলা, মাথায় পেরেক ঢুকানো, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে ফেলা প্রভৃতি।

ভ্লাদ মুসলিম না হয়েও কোরআন, হাদিস, দর্শন, বিজ্ঞান, অস্ত্রশিক্ষায় দীক্ষা নিতে থাকেন। ১৪৪৭ সালে তার বাবা ভ্লাদ ড্রাকুলকে হত্যা করা হয় এবং তার বড় ভাই মিরসাকে গরম লোহার রড দিয়ে অন্ধ করে জীবিত কবর দেয়া হয়। ক্রোধান্বিত ভ্লাদ তখন থেকেই মূলত নিজেকে ‘ভ্লাদ ড্রাকুলা’ বা ‘ড্রাগনের সন্তান’ বলে পরিচয় দিতে থাকে। এদিকে তার প্রথম স্ত্রী দুর্গের টাওয়ার থেকে আর্গেস নদীতে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। বাবা, ভাই এবং স্ত্রী পরপর তিনজন কাছের মানুষের করুণ মৃত্যু তার মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে।

দ্বিতীয় ভ্লাদ অর্থাৎ বাবার কাছ থেকেই এই অত্যাচারী হওয়ার প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন তৃতীয় ভ্লাদ। ধীরে ধীরে হাঙ্গেরির সঙ্গে ওয়ালাসিয়ার রাজার সম্পর্কের অবনতি হয়। ওয়ালাসিয়ার শাসক তখন ছিলেন দ্বিতীয় ভ্লাদিস্লাভ। হাঙ্গেরির সমর্থনে ১৪৫৬ সালে ফের ওয়ালাসিয়া জয় করে নেন তৃতীয় ভ্লাদ। ১৪৬২ সালে অটোমান সাম্রাজ্যও আক্রমণ করেন তৃতীয় ভ্লাদ। সেই যুদ্ধ জেতার জন্য হাঙ্গেরির তত্কালীন রাজা মাথিয়াস করভিনাসের সাহায্য চান তিনি। তবে করভিনাস উল্টে তাকেই বন্দি করে নেন। দ্বিতীয় ভ্লাদকে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে বন্দি করে রেখেছিলেন মাথিয়াস।

টানা ১২ বছর এক গোলকধাঁধা দুর্গে বন্দি জীবন কাটিয়েছিলেন তৃতীয় ভ্লাদ। সেখানে তার উপর অকথ্য নির্যাতন করা হত। তৃতীয় ভ্লাদের সেই দুর্গই আজ কাউন্ট ড্রাকুলার দুর্গ বলে পরিচিত। ট্রানসিলভ্যানিয়ার মতো ড্রাকুলার এই দুর্গেও ঘুরে দেখতে পারেন পর্যটকেরা। এই দুর্গের কোনো মানচিত্র নেই। অন্ধকার সেই গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা। দুর্গের ভেতরেই রয়েছে কারাগার। যার মধ্যে একটি ‘ড্রাকুলা কক্ষ’ নামাঙ্কিত।

এই কারাগারের ভেতরেই জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন তৃতীয় ভ্লাদ। ১৪৬৩ সাল থেকে ১৪৭৫ পর্যন্ত এখানে ছিলেন তিনি। পাশের রাজ্য মলদাভিয়ার রাজার অনুরোধে তাকে ১৪৭৫ সালে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। তবে মুক্তি পেলেও হাঙ্গেরির দাস হয়েই জীবন কাটাতে হচ্ছিল তাকে। ১৪৭৭ সালে হাঙ্গেরির রাজা করভিনাস তাকে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠান। সেই যুদ্ধেই নিহত হন তিনি।

ব্যক্তিগত জীবনে তৃতীয় ভ্লাদ ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারী রাজা। রাজত্বকালে তিনি প্রজাদের কাছে ত্রাস ছিলেন। এক দিকে তার নির্মম মনোভাব এবং নিষ্ঠুরতা, অন্য দিকে বাবার থেকে প্রাক্তন নাম (ড্রাকুলা)। এই দুটো মিলিয়ে বিশ্বের কাছে তিনিই হয়ে উঠেছেন ভ্যাম্পায়ার কাউন্ট ড্রাকুলা।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.