যে গ্রামে পুরুষ নিষিদ্ধ

Odd বাংলা ডেস্ক: বছর পনেরো আগের কথা। রোজালিনা লিয়ারপুরা তখন ছোট্ট শিশু। তিন বছর বয়স। বাবাকে সে কখনোই দেখেনি। শুনেছে, বাবা নাকি তার জন্মের আগেই মারা গেছেন। মা তাকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকতেন। তারা কেনিয়ার সাম্বরু জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। তাদের সমাজ ভয়ংকরভাবে পুরুষতান্ত্রিক। এখনো আছে বহু বিয়ের চল। এমনকি প্রচলিত আছে মেয়েদের ‘খতনা’র কুখ্যাত প্রথা। ছোট থাকতেই কেটে ফেলা হয় মেয়েদের যৌনাঙ্গের খানিকটা অংশ। বাবা নেই। মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না একা সে প্রথার হাত থেকে মেয়েকে বাঁচানো। তাই রোজালিনাকে নিয়ে তিনি পালিয়ে আসেন উমোজা গ্রামে।

ওদিকে জেনের ছিল একটা সাজানো সংসার। স্বামী, শাশুড়ি, সন্তান নিয়ে। একদিন হঠাৎ করেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। সাম্বরুদের প্রধান পেশা পশু পালন। জেনের স্বামীরও ছিল অনেক ছাগল আর ভেড়া। সেগুলো চড়াতেই বের হয়েছিলেন জেন। পাশাপাশি কুড়াচ্ছিলেন লাকড়ি। এর মধ্যেই কোথা থেকে আসে তিনজন লোক। সামরিক উর্দি পরা। একা পেয়ে তাঁকে ধর্ষণ করে। ধস্তাধস্তিতে তাঁর পায়ে গভীর ক্ষত হয়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ঘটনাটা বলেন তাঁর শাশুড়িকে। তাতে ফল হয় উল্টো। স্বামী শুনে তাঁকে বেদম প্রহার করেন। বাড়ি থেকে বের হয়ে যান জেন সন্তানদের নিয়ে। চলে আসেন উমোজায়।

‘উমোজা’ সোয়াহিলি ভাষার শব্দ। অর্থ ‘একতা’। ১৫ নারীর যূথবদ্ধতায় যাত্রা শুরু হয়েছিল এই গ্রামের। ১৯৯০ সালে। কেনিয়ার সাম্বরু অঙ্গরাজ্যের আর্চার্স পোস্ট শহরের কাছে। রাজধানী নাইরোবি থেকে প্রায় আড়াই শ মাইল দূরে। তাঁরা সবাই হয়েছিলেন ধর্ষণের শিকার। ব্রিটিশ সেনাদের দ্বারা। সে ঘটনার পর সেখানকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাঁদের ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। অথচ তাঁদের কোনো দোষ ছিল না। তাই তাঁরাই উল্টো সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখান। গড়ে তোলেন পুরুষহীন এই গ্রাম।

গ্রামটি প্রতিষ্ঠার মূল কারিগর রেবেকা লোলোসোলি। এ জন্য তাঁকে চড়া মূল্যও দিতে হয়েছিল। ‘আমি যখন এই ভাবনার কথা বাকি মেয়েদের বলতে শুরু করি, লোকজন ভীষণ খেপে গিয়েছিল। একদল লোক আমার ওপর চড়াও হয়। এমন মেরেছিল যে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। মেরে আমাকে তারা ‘শিক্ষা’ দিতে চেয়েছিল’, বলেন রেবেকা। কিন্তু দমে যাননি তিনি। তাঁর নেতৃত্বে নির্যাতিতা ১৫ নারী যাত্রা শুরু করেন উমোজার। ধীরে ধীরে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে পুরুষহীন গ্রামটির নাম।

হ্যাঁ, উমোজায় কোনো পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই। ছোট্ট গ্রামটার চারদি কাঁটার বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেটা ডিঙিয়ে কোনো পুরুষ প্রবেশ করলেই তাকে চালান করা হয় স্থানীয় থানায়। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সেখানকার ভীষণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মেয়েদের কাছে সেটার মাহাত্ম্য একেবারেই অন্য রকম। পুরুষ নেই মানে নারীর প্রতি সহিংসতা নেই, নির্যাতন নেই, ধর্ষণ নেই। আর তাই এক এক করে সেসবের শিকার নারীরা এসে যোগ দিতে থাকে তাদের সঙ্গে। বাবা হয়তো টাকার বিনিময়ে বাচ্চা মেয়েকে তুলে দিচ্ছিল কোনো বুড়োর হাতে। কিংবা স্বামীর নির্যাতন থেকে পালিয়ে আসা কোনো মেয়ে বা ধর্ষণের শিকার। অথবা মেয়েকে ‘খতনা’র হাত থেকে বাঁচাতে চাওয়া মা। বর্তমানে তাঁদের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। আর তাঁদের সন্তান আছে শ দুয়েক।

অবশ্য সাম্বরুদের সব ঐতিহ্যই মন্দ নয়। যেমন তাদের গয়নাগুলো দেখতে দারুণ সুন্দর। ভীষণ রংচঙে। সেগুলোই উমোজার নারীদের আয়ের মূল উৎস। কাছেই আছে সাম্বরু ন্যাশনাল রিজার্ভ পার্ক। অসংখ্য পর্যটক যায় সেখানে। তারাই গয়নাগুলোর মূল খদ্দের। অনেকে আতিথ্যও গ্রহণ করে। অবশ্যই টাকার বিনিময়ে। এর বাইরে রেবেকাদের আয়ের আরো একটা উৎস আছে। অনুদান। তাদের এই সংগ্রামে একাত্মতা প্রকাশ করে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ টাকা পাঠান। এই সব টাকা জমা দেওয়া হয় রেবেকার কাছে। তিনি প্রয়োজন অনুযায়ী ভাগ-বাটোয়ারা করে দেন সবার মধ্যে। এমনিতেই ব্যাপারটা এক অনন্য। সেটার মাহাত্ম্য আরো বেড়ে যায় সেখানকার বাস্তবতা বিবেচনায়। কারণ এখনো সাম্বরুদের মধ্যে নারীদের অর্থ উপার্জন করার সামাজিক মর্যাদাটুকুও নেই! সেই স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে খুশিতে যেন নেচে ওঠেন নাগুসি। বেশ কিছুদিন ধরে উমোজায় আছেন তিনি। বলেন, ‘এখানে আমি অনেক কিছুই করতে পারছি, যেগুলো আমাদের সমাজে নারীদের জন্য একেবারে নিষিদ্ধ। এই যেমন নিজের টাকা নিজেই উপার্জন করা। কোনো পর্যটক যখন আমার বানানো গয়না কেনে, গর্বে বুকটা ভরে যায়।’

শুধু টাকা উপার্জনেরই নয়, উমোজার নারীরা গড়ে তুলেছেন নিজেদের মতো একটা শিক্ষাব্যবস্থাও। আশপাশের গ্রামগুলোর মেয়েদের জন্য। তাদের নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাঠ দেন প্রবীণ ও অভিজ্ঞরা। এর মাধ্যমে গড়ে তুলছেন সামাজিক সচেতনতা। বিশেষ করে বাল্যবিয়ে ও মেয়েদের যৌনাঙ্গ ছাঁটার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি ওখানে একটা স্কুলও খোলা হয়েছে। তাতে উমোজার বাচ্চারা তো বটেই, পড়তে আসে আশপাশের গ্রামের শিশুরাও।

সব মিলিয়ে উমোজা হয়ে উঠেছে নির্যাতিত নারীদের আশ্রয়স্থল। সমাজে যে নারীদের জায়গা নেই, উমোজা তাদের দিচ্ছে নতুন জীবন। যেমন—রোজালিনা এখন পড়ছে কাছের একটা উচ্চ বিদ্যালয়ে। একাদশ শ্রেণিতে। স্বপ্ন দেখছে শিক্ষক হওয়ার। অথচ ওর জীবনটা থমকে যেতে পারত অনেক আগেই। সে কথা অকপটে স্বীকার করে সে নিজেই, ‘এখানে না এলে আমি জানতেই পারতাম না জীবন কেমন হতে পারে। আমি তাই শিক্ষক হতে চাই। মেয়েদের শেখাতে চাই, রীতি আছে বলেই যৌনাঙ্গ ছাঁটার প্রয়োজন নেই।’ আর সার কথাটা বলে দেন জুডিয়া। তিনি এখানে এসেছেন বছর ছয়েক আগে। টাকার বিনিময়ে তাঁকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলেন বাবা। এখন তাঁর বয়স ১৯ বছর। বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলেই আমার মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করে। কারণ চারপাশের সবাই আমার ভালো চায়। পরস্পরকে সাহায্য করে। অন্যত্র পুরুষরা নারীদের নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মেয়েরা চাইলেও কিছু করতে পারে না। কিন্তু উমোজায় নারীরা স্বাধীন।’

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.