হোটেল-কর্মী নন, ভবিষ্যতে রোবট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিই বুঝে নেবে অতিথিরা কী চান!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ধরুন আপনি অনেকদিন যাবত টানা কাজের চাপের ব্যস্ত, হঠাৎ মোবাইলে টুং করে বেজে উঠলো কোনো শব্দ। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলেন ইমেইল এসেছে- কিছুদিন অবকাশযাপন করা উচিত আপনার; সেই সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যেসব শহরে আপনি ভ্রমণ করার ইচ্ছা, সেখানকার সবগুলো রিসোর্টের তালিকা।


অতএব আপনি ভ্রমণের দিনক্ষণ নির্ধারণ করলেন এবং হোটেলে গিয়ে উঠলেন। যাওয়ার সাথেসাথেই স্টাফরা আপনাকে এমন একটি কক্ষে নিয়ে গেল যেখান থেকে সমুদ্রের জলরাশির সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে পারবেন, বাথরুমে আপনার পছন্দসই বাড়তি সাবান-তোয়ালে থাকবে এবং পরদিন ঠিক নয়টায় আপনাকে ঘুম থেকে তুলেও দেওয়া হবে। তাদের আগে থেকেই জানা থাকবে যে আপনি গ্লুটেনমুক্ত মেন্যু পছন্দ করেন এবং দেরিতে চেকআউট করবেন... অর্থাৎ, অবকাশযাপনের দিনগুলো হবে একেবারেই আপনার মনের মতো। আর এসবের জন্য আপনাকে একটি বাক্যও ব্যয় করতে হবে না হোটেল কর্তৃপক্ষ বা স্টাফদের পেছনে!


ভাবছেন মজা করছি? না, মোটেই নয়। হংকংভিত্তিক বেসরকারি হোটেল ব্যবস্থাপনা চেইন রোজউড হোটেল গ্রুপ এর সিইও সোনিয়া চেং ডেটা অ্যানালিটিক্সের সাহায্য নিয়ে তার হোটেল ব্যবসাকে ভবিষ্যতে ঠিক এতটাই আধুনিক করতে চান। রোজউড হোটেল গ্রুপ বর্তমানে লন্ডন, প্যারিস, বেইজিং, আবু ধাবিসহ বিশ্বের ১৬টি দেশে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। একটি টেক-প্রজেক্টের আওতায় হোটেল ব্যবস্থাপনায় এমন সব প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নিচ্ছেন চেং, যা সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না!


চেং কেন তার প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করছেন তা জানিয়েছেন দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। মহামারির পর হোটেল ও পর্যটন খাতে ব্যাপক লোকসান এবং কর্মীর অভাবের ফলে বিভিন্ন দায়িত্ব সম্পাদন করতে নতুন প্রতিভা খুঁজছে রোজউড হোটেল । কিভাবে মহামারি এত অল্প সময়ে মানুষের কাজ ও ভ্রমণের ধরন পাল্টে দিয়েছে, হোটেল শিল্পের কাণ্ডারিদের জন্য তার পরামর্শ কী এবং এই শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে নিজের ভাবনা-পরিকল্পনা দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট- এর সাথে শেয়ার করেছেন চেং।


হাই টেক বনাম হাই টাচ


যেহেতু হোটেল শিল্প খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে চাইছেন সোনিয়া চেং, তাই তার প্রতিষ্ঠান রোজউডে কর্পোরেট কর্মীদের কর্মনীতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। জবাবে চেং জানান, তার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকরা যার যার টিম এর কাজ পরিচালনা করে। সপ্তাহে কতদিন অফিসে যেতে হবে, এমন কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই সেখানে। যদি কারো সত্যিই হোম অফিস করার দরকার হয়, তাহলে সে করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির এই কর্মনীতির প্রশংসা করেছেন কর্মীরা। প্রতিভাবান মানুষেরা এখানে কাজ করতে আগ্রহী হওয়ার পেছনে এটি একটি বড় কারণ বলে মনে করেন চেং।


মহামারি-পরবর্তী সময়ে হোটেল ব্যবস্থাপনায় কী কী পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন কর্মীরা, এমন প্রশ্নে সোনিয়া চেং বলেন, "আমরা চেষ্টা করছি দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ কাজগুলো রোবটিকস বা মেশিং লার্নিং পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পাদন করা যায় কিনা। অটোমেশন ও প্রযুক্তি আমাদের কর্মীদের কাজকে সহজ করতে পারে কিনা তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। হসপিটালিটি শিল্পে এখনো বেশিরভাগ কাজে মানুষেরই হাত লাগাতে হয়। তাই হাই টেক ও হাই টাচের মধ্যে একটি ভারসাম্য রাখতেই হবে।"


তবে চেং মনে করেন, গ্রাহকেরা সেরা আথিথেয়তা পাওয়ার সুবিধার্থে হোটেলের কর্মীদের সাথে একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান, যা প্রযুক্তি কখনো দিতে পারবে না।


মহামারি-পরবর্তী বিশ্বে অন্য সবকিছুর মতো হোটেল শিল্পেও এসেছে নানা পরিবর্তন। তবে নমনীয়তা বা পরিবর্তনযোগ্যতা থাকাটা জরুরি বলে করেন চেং। মহামারিকালে খুব অল্প সময়ের মধ্যে নতুন নতুন নিয়মকানুন আরোপ করতে হয়েছিল হোটেলগুলোতে, সরাসরি সংস্পর্শে না এসেই চেক-ইন, হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিষদের মধ্যে হাইব্রিড মিটিং; আবার অনেক অনেক শহরেই মানুষ হোটেলে দীর্ঘদিনের জন্য থাকতে (স্টেকেশন) শুরু করেছিল। চেং জানান, হংকং-এ রোজউড হোটেলই প্রথম স্টেকেশন ব্যবস্থা চালু করে।


ভ্রমণের ট্রেন্ড পরিবর্তন


ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ভ্রমণের সময় মানুষ সাধারণত একটু বেশি দিন হোটেলে থাকতে চায় যাতে এখানে থেকে তারা সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। অনলাইনে যুক্ত থেকে কাজ করার মতো প্রযুক্তি বের হয়েছে বলেই ভ্রমণের সময়ও মানুষ কাজ করতে পারে। তাই বর্তমানে মানুষের অবকাশযাপনের সময়কালও বেড়েছে।


কিন্তু অবকাশযাপনে এসে অতিথিরা আসলে কী কী চাইছেন? আগের চাওয়া-পাওয়ার সাথে বর্তমানের পার্থক্য কী? চেং জানান, বর্তমানে গ্রাহকেরা কোন হোটেল কতটা বিশেষায়িত সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে সেদিকে নজর দিচ্ছেন। গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে রোজউড হোটেলের রয়েছে নিজস্ব স্বাস্থ্যসেবা ব্র্যান্ড 'আসায়া'। এছাড়াও 'রোজউড রেসিডেন্সেস' (আবাসিক ভিলা, এস্টেট অ্যাপার্টমেন্ট ব্র্যান্ড) এর অধীনে তারা ব্যক্তিগত ভিলা ও বিলাসবহুলভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে গ্রাহকদের। চেং বলেন, "রোজউড শুধুমাত্র একটা হোটেল ব্র্যান্ড নয়, এটা তার চেয়েও বেশি কিছু। আমরা এটিকে একটি বিলাসবহুল লাইফস্টাইল ব্র্যান্ডে পরিণত করবো, যেখানে গ্রাহকদের জন্য থাকবে অসংখ্য পণ্যসামগ্রী।"


হোটেল প্রযুক্তির বিবর্তন


সোনিয়া চেং এর কাছে প্রশ্ন ছিল- গ্রাহকসেবায় কী কী পরিবর্তন আসছে এবং ভবিষ্যতের জন্য কী পরিকল্পনা করছেন তিনি। এর উত্তরে চেং বলেন, "মহামারি-পরবর্তীকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হোটেলে আগত অতিথিদের নাম মনে রাখা এবং তাদের কী কী চাহিদা থাকতে পারে তা পূর্বানুমান করা। তাই আমরা 'ডেটা লেক হাউজ' নামক একটি কেন্দ্রীয় সিস্টেম তৈরি করছি যেখানে আমরা অতিথিদের প্রোফাইলের উপর ভিত্তি করে তাদের পছন্দ সম্পর্কে অনুমান করবো এবং সে অনুযায়ী সেবা দিবো।"


কিন্তু হোটেল সেবায় প্রযুক্তির ব্যবহারে কোন দিকটিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে রোজউড? এক্ষেত্রেও ডেটা লেক হাউজের কথাই জানালেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও। চেং এর ভাষ্যে, এটি এত বিশাল একটি প্রজেক্ট যা হোটেলে আগত অতিথিদের পুরো অভিজ্ঞতাই বদলে দিবে! হোটেলে থাকাকালীন কোন অতিথি কিভাবে থাকতে পছন্দ করছে, কোন বিষয়গুলোতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন সবকিছু রেকর্ড করা থাকবে।


বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত কর্মীদের এক ছাদের তলায় নিয়ে আসতে রোজউড ব্যবহার করছে দ্য ইনসাইডার অ্যাপ। সেখানে তারা কোম্পানির খবরাখর, আপডেট, ছবি, ভিডিও এবং মজার মজার অভিজ্ঞতা বা অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প শেয়ার করেন। এভাবেই তাদের নিজস্ব একটি সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে।

এখানেই শেষ নয়, রোজউডসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এনএফটি এবং মেটাভার্সের মতো উদীয়মান প্রযুক্তির দিকে তাকিয়ে। তবে এখনই এর কার্যকারিতা সম্পর্কে কিছু বলতে নারাজ সোনিয়া চেং। তবে জানালেন, তারা যদি এই প্রযুক্তি দিয়ে কিছু তৈরি করেন তাহলে তা ব্র্যান্ডের সঙ্গে মানানসই এবং অদ্বিতীয় কিছুই হবে।


প্রতিভার অন্বেষণে


বর্তমানে কর্মীরা কর্মক্ষেত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশ চিন্তাভাবনা করে পা বাড়াচ্ছেন বলে ধারণা চেং এর। কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানো এবং ইতিবাচক প্রভাব রাখার ক্ষমতা যেসব প্রতিষ্ঠানের আছে, তারা সেদিকেই ঝুকছেন। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য কী, সেটিও তাদের কাছে একটি বড় বিষয়। শুধু ভালো ব্যবসাই নয়, সমাজের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানেই যোগ দিতে চান তারা।

সোনিয়া চেং এর মতে, এই মুহূর্তে হোটেল শিল্পে এবং তার নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হলো দক্ষ-প্রতিভাবান কর্মীর অভাব। কিন্তু একই সাথে প্রতিষ্ঠানকেও কর্মী আকর্ষণের জন্য কাজ করে যেতে হবে। কাজের চাপ কমাতে প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি কর্মীদের ক্যারিয়ার গড়তেও সাহায্য করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.