মার্সেনারি কুইন: ভারতের বিস্মৃত নারী—তার ক্ষমতার রহস্য কী ছিল?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: পুরান দিল্লি কত শত বছরেরই না প্রাচীন। তার আনাচেকানাচে পসরা সাজিয়ে বসে থাকে স্মৃতির মহল। পুরান দিল্লির কেন্দ্রীয় বাজার এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে সাদা পাথরের এমনই এক অট্টালিকা। প্রথম দেখায় আশেপাশের অন্যান্য অবহেলিত ভবন থেকে এটিকে আলাদা করে চেনারও উপায় নেই। বলার উপায় নেই, ছোট ছোট অগুনতি দোকান যেখানে আজ বৈদ্যুতিক পণ্য, এক্স-রে ফিল্ম, ইলেকট্রোডায়োগ্রাম জেলির মতো বিচিত্র পণ্য বেচছে– এই দালানেই এককালে বাস করতেন ভারতের অন্যতম ধনী ও ক্ষমতাধর এক নারী। বিলাসব্যসন আর ক্রুর মেধায় যার জুড়ি মেলা ছিল ভার। শাহী দরবারের নর্তকী থেকে যিনি কখনো হয়েছেন ভাড়াটে যোদ্ধা; কখনোবা কূটনৈতিক আর রানি।


বহু রঙের রহস্যময় এ নারী হলেন সামরু বেগম। তিন হাজার সেনা ছিল তার অধীনে; যার মধ্যে অন্তত কয়েকশ ছিল ভাড়াটে ইউরোপীয় যোদ্ধা। ১৮ শতকের উত্তর ভারতে পারিষদবেষ্টিত দরবার বসতো তার। ক্ষমতার প্রদর্শন করতেন তিনি পাগড়ি পরে, হুক্কায় আয়েশি গুড়ুক গুড়ুক শব্দ তুলে।


জন্মসূত্রে ছিলেন মুসলমান, পরে ধর্মান্তরিত হন ক্যাথলিক খৃষ্টধর্মে। জোয়ান অব আর্কের অনুকরণে নিজেও নামধারণ করেন জোয়ানা। তবে আমৃত্যু সামরু পরিচিতি ছিল তার।


এত এত বৈচিত্র্যের সমাহার যার চরিত্রে– সেই তিনিই আজ ইতিহাস বিস্মৃত। অধিকাংশ মানুষই জানে না তার কথা। বাজারহাটে পরিণত হওয়া এই ভাগীরথ প্রাসাদই আজ ভারতের বর্ণিল ইতিহাসে বেগম সামরুর অস্তিত্বের মাত্র দুই সাক্ষীর একটি।


বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও নারীবাদী উমা চক্রবর্তী বলেন, 'নারীদের সরাসরি ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ আজো ভারতীয় সমাজে স্বীকৃত নয়। ৫৪৩ আসনের পার্লামেন্টে নারীদের অধিকার ৭৮ আসনে। কিন্তু, যে রাজনৈতিক দলেরই হোন না কেন–পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্বের ছায়াতলেই তাদের রাজনীতি করতে হয়'।


উমা চক্রবর্তীর মতে, বেগম সামরু ছিলেন তার ব্যতিক্রম। 'তিনি রাজনৈতিক পালাবদলের কালে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উঠেছেন; নিজেই নিজের জায়গা তৈরি করেছেন'।



বেগম সামরুকে বুঝতে হলে ১৭ শতকের মোগল সাম্রাজ্য সম্পর্কে জানাটা খুবই জরুরি। সময়টা ছিল উত্তাল। মোগলদের কেন্দ্রীয় শাসন একের পর এক স্থানীয় শাসকদের বিদ্রোহের মুখে পড়ছিল। তার পাশাপাশি চলছিল ব্রিটিশদের আগ্রাসন ও উপনিবেশ স্থাপন।


সেই অস্থির শতাব্দীর মাঝামাঝি ১৭৫০ সনে জন্মগ্রহণ করেন বেগম সামরু। পারিবারিক নাম রাখা হয়েছিল- ফারজানা। কেউ কেউ মনে করেন, তিনি অভিজাত কোনো মুসলমান পরিবারে জন্মান। অন্যদের মতে, ফারজানা ছিলেন এতিম। বড় হয়েছেন বাঈজী কোঠায়।


সে যুগে বিদ্রোহী স্থানীয় শাসকদের দমন করতে ইউরোপীয় মার্সেনারিদের ভাড়া করতেন মোগল বাদশাহ বা সুবেদাররা। এমন একজন মার্সেনারি ছিলেন অস্ট্রিয়া থেকে আসা ওয়াল্টার রেইনহার্ড। ১৭৬৩ সালে পাটনায় ১৫০ জন ইংরেজকে হত্যা করায় 'পাটনার কসাই' নামে কুখ্যাত হয়েছিলেন।


রেইনহার্ড ছিলেন বিবাহিত, তবু ৪৫ বছর বয়সে তিনি মজেছিলেন ১৪ বছরের ফারজানাতে। দুজনের দেখাও হয়েছিল কোঠা বা বাঈজী বাড়িতেই। যুগলবন্দী হয়ে তারা গড়ে তুলেছিলেন এক ভাড়াটে যোদ্ধা বাহিনী।


মোগল রাজন্যদের দরবারে নাচতেন ফারজানা; তারা তাকে সম্মানজনক 'বেগম' উপাধি দেন। তার প্রেমিক রেইনহার্ডের ডাকনাম ছিল 'লে সমব্রে'। রেইনহার্ডকে তিনি বিয়েও করেছিলেন। ধারণা করা হয়, প্রেমিকের নামের আদলেই নিজের ডাকনাম সামরু করেন ফারজানা।


তবে সামরু বেগম বিয়ে করেননি বলেই মনে করেন ঐতিহাসিক অদিতি দাস গুপ্ত। কারণ বিয়ে করলে তাকে পর্দা করতে হতো। ফলে তিনি আরও সহজে মোগল রাজন্যদের কাছাকাছি থাকতে পারতেন না। জানতে পারতেন না, রাজনীতির দাবার গুঁটিতে কখন কোন চাল দেয়া হচ্ছে।



সম্প্রতি প্রকাশিত তার বই 'দ্য ওম্যান হু রুলড ইন্ডিয়া: লিডারস, ওয়ারিয়র্স, আইকনস- এ বেগম সামরুর সম্পর্কে অদিতি লিখেছেন, 'নারী হয়ে জন্মালে জীবনে অনেক কিছুতে ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে– এই ধারণায় বিশ্বাস করতেন না তিনি। তার পরিবর্তে একজন শাসক হিসেবে টিকে থাকতে যা যা করা দরকার–তিনি নির্দ্বিধায় তাই করেছেন'।


রেইনহার্ডের মৃত্যুর পর সারধানা রাজ্য শাসন করেন সামরু। ছিলেন নিজস্ব সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। টানা পাঁচ দশক ধরে দিল্লি থেকে ৮৫ মাইল দূরে অবস্থিত এ রাজ্য ছিল মোগলদের শক্ত ঘাঁটি।


শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলেই মোগল বাদশাহরা রানি সামরুকে ডেকে পাঠাতেন। যুদ্ধের জন্য তার সেনাবাহিনী সর্বদা প্রস্তুতই থাকতো। তা ছাড়া, বিরোধী পক্ষের সাথে সন্ধি আলোচনাতেও দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন সামরু। এসব গুণের কারণেই এক মোগল বাদশাহ তাকে জেবুন নিসা (নারীদের মধ্যে অলঙ্কার) উপাধিতে ভূষিত করেন।


বেগম সামরুর জীবনীলেখক জুলিয়া কে'র মতে, 'সামাজিকতার বেড়াজাল ছিন্ন করা এই নারী ছিলেন সুদূর ইউরোপ থেকে আসা বিদেশিদের কাছে এক বিস্ময়। এজন্য তাদের কেউ কেউ সামরুর উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যকে স্মরণ করেছেন নিজেদের লেখনীতে। হোক সে সামরিক পরিকল্পনার, হত্যাযজ্ঞের, বীরত্বের বা বিশ্বাসঘাতকতার'।


রাজদরবারের বাইরেও 'অ্যাডভেঞ্চার' করে বেড়িয়েছেন সামরু। একের পর এক ইউরোপীয় প্রেমিক বদলেছেন অবলীলায়। এমনকী গোপন এক ফরাসী প্রেমিকের সাথে (দুজনে একসাথে) আত্মহত্যার সন্ধিও করেছেন। কথা তিনি রেখেছিলেনও। একবার শত্রুর আক্রমণের মুখে তারা দুজনে যখন পালাচ্ছিলেন, তখন নিজেকে ছুরিবিদ্ধ করেন সামরু। তার রক্তাক্ত পোশাক দেখে বিচলিত ফরাসী প্রেমিকটি গুলি করে নিজের জীবনাবসান করেন। প্রেমিক না বাঁচলেও, সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে ফেরেন সামরু। তার প্রাণ বাঁচান জাহাজঘাটার শ্রমিক থেকে ভাড়াটে সৈনিক হয়ে ওঠা এক আইরিশ পুরুষ। তার সাথেও গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। এই প্রেমিকের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও সন্তানদের দেখভালের দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন।


ভারতীয় ইতিহাসের পাতায় অধিকাংশক্ষেত্রে যাদের উপস্থিতি বাদ পড়েছে, এমন ২০ জন উল্লেখযোগ্য নারীর জীবন নিয়ে লিখেছেন গারোদিয়া-গুপ্ত। বইটিতে উঠে এসেছে মোগল ও ব্রিটিশদের মধ্যে বেগম সামরুর কূটনীতির ইতিহাস।



সামরু ইউরোপীয়দের কাছে গুরুত্ব পাওয়ার আরেক কারণ- তার ক্যাথলিক খৃষ্টধর্ম গ্রহণ। আসলে রেইনহার্ডের মৃত্যুর পর তিনি ধর্মান্তরিত হন। নিজ রাজ্য সারধানায় নির্মাণ করেন 'ব্যাসিলিকা অব আওয়ার লেডি অব গ্রেসেস' উপাসনালয়। প্রকৌশলী ছিলেন তার সেনাবাহিনীর এক ইতালীয় অফিসার।  


গারোদিয়া গুপ্ত উল্লেখ করেন, 'সামরু উপলদ্ধি করেন, ব্রিটিশরাই হবে ভারতের পরবর্তী শাসক। ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন হয়তো তাদের খুশি করতেই। অথবা এমনও হতে পারে, তিনি খৃষ্টধর্মকে সত্যিসত্যিই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন'।


জুলিয়া কে লিখেছেন, 'তিনি কখনো বিদেশি অতিথিদের সাথে খানাপিনা করেছেন বলে জানা যায় না। এমনকী অভিজাত খৃষ্টানদের প্রিয় পানীয়- ওয়াইন কখনো ছুঁয়েও দেখেননি। তবে দাওয়াতে আসা মেমসাহেবদের খাওয়া শেষ হলে, তিনি একজন চাকরকে তার হুক্কা আনার হুকুম দিতেন। অতিথি পুরুষরা তখন চুরুট ধরাতো, আর তাদের সাথে বসে হুক্কা টানতেন, রাজনীতি আর ষড়যন্ত্রের আলাপে মশগুল হতেন বেগম সামরু'।


১৮৩৬ সনে জানুয়ারিতে মারা যান এককালের বাঈজী থেকে রানি হয়ে ওঠা বেগম সামরু। রেখে গিয়েছিলেন ৫ কোটি ৫ লাখ স্বর্ণমুদ্রার বিপুল সম্পদ, যার দখল নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আজকের দিনে এই সম্পদের মূল্য ৪ হাজার কোটি ডলার।


সারধানা রাজ্যে তারই নির্মিত চার্চের নিচে রানি সামরুকে সমাহিত করা হয়। সমাধি বেদির কাছে নির্মাণ করা হয় ১৮ ফুট উচ্চতার এক শ্বেতপাথরের ভাস্কর্য, যেখানে শাল আবৃত সামরুকে সিংহাসনে সবার উপরে স্থান দেয়া হয়েছে।


পুরান দিল্লির ভাগীরথ প্রাসাদে আবারো ফেরা যাক। কালের আঘাতে ভেঙে পড়ার উপক্রম এই প্রাসাদ। গ্রিক স্থাপত্যকলার লম্বা পিলারগুলোর সাড়িতে পসরা সাজিয়ে  বসা দোকানে দোকানে আজ পুরুষদেরই আধিপত্য। চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রি করতে দেখা যায় কেবল এক বৃদ্ধাকে।


তিনি প্রতিবেদক  প্রিয়াঙ্কা বোরপূজারীকে দেখে খেঁকিয়ে ওঠেন, 'কী চাই আপনার? (কিছু না চাইলে) আপনাকে দেওয়ার মতো সময় নেই আমার কাছে (মানে মানে কেটে পড়ুন)'। তার কথাগুলো অন্তত সামরুর ইতিহাসকেও ফিরিয়ে আনে, তিনিও তো তার সময়ের ধার ধারেননি। এগিয়ে গেছেন নিজ গতিতে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.