এই শহরে জন্ম মৃত্যু নিষিদ্ধ, নেই বিড়াল পোষার অনুমতিও

Odd বাংলা ডেস্ক: জন্ম মৃত্যু একই সূত্রে গাঁথা। প্রতিটি প্রাণেরই একদিন না একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। প্রকৃতির নিয়মে মানুষ মাত্রই মরণশীল। শত চেষ্টা করেও মৃত্যুকে আটকে রাখার ক্ষমতা কারও নেই। তবে এমন এক শহর আছে যেখানকার বাসিন্দাদের মরতে মানা! নরওয়ের সালবার্ডের কেন্দ্রে মাত্র দুই হাজার মানুষের বাসস্থান লংইয়ারবিন শহর। এ শহরে জন্ম ও মৃত্যু নিষিদ্ধের আইন রয়েছে। এমনকি শহরে বিড়াল পালনও নিষিদ্ধ। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটিই সত্যি!

স্ক্যান্ডিনেভিয়ানের উত্তর ইউরোপের তিনটি দেশ তথা রাজতন্ত্র-নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্কের জন্য দেয়া নাম। এদের মধ্যে নরওয়ে ও সুইডেন স্ক্যান্ডিনেভীয় উপদ্বীপ গঠন করেছে। দেশ তিনটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত দিক থেকে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই স্ক্যান্ডিনেভিয়ানে একসময় অন্যতম বৃহৎ কয়লাখনি ছিল। এই কয়লাখনিতে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য লংইয়ারবিনে একটি জায়গা ঠিক করা হয়। খাড়া পাহাড় আর বেশ কয়েকটি হিমবাহ দিয়ে ঘেরা শান্ত ও নিরিবিলি জায়গা অ্যাডজেন্টফোর্ড। 

এই অ্যাডজেন্টফোর্ডেরই উপকূলে অবস্থিত লংইয়ারবিন। এই এলাকায় মাত্র ৪০ কিলোমিটারের মতো রাস্তা রয়েছে, যেটি আবার শহরের কেন্দ্র ও নতুন শহর নাইবিনের মধ্য দিয়ে বিভক্ত হয়েছে। উত্তর মেরু থেকে ৭৮ ডিগ্রি অক্ষাংশে এবং নর্থ পোল থেকে মাত্র ১৩১৬ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই লংইয়ারবিন। সালবার্ড আর্কিপেলাগোর সবচেয়ে বড় দ্বীপ স্পিটসবার্গের মধ্যে অবস্থিত এ শহরটি। ২০০০ সালের দিকে, যখন এই শ্রমিকরা চলে যাওয়ার বদলে এ জায়গায়ই স্থায়ীভাবে বাস করা শুরু করে, তখন এটি পরিণত হয় ছোট্ট শহরে। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে পর্যটন নগরী।

মানুষের ভ্রমণের জন্য আকর্ষণীয় হলেও এ শহরের বাসিন্দারা বেশ কয়েকটি কঠিন নিয়ম মানেন। এই নিয়মগুলো নতুন যে কেউ শুনেই স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ বিস্মিত হয়। তবে তাদের কাছে এগুলো খুব সাধারণ নিয়ম এবং অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। আর এ নিয়মগুলো তৈরি করা হয়েছে এখানকার আবহাওয়ার জন্য। যতই শহর বিকশিত হয়েছে, ততই মানুষ পৃথিবীর শেষ প্রান্তের এ শহরকে খুব সাধারণ জীবনযাপনের জন্য বেছে নিয়েছে। বছরের দীর্ঘ একটা সময় অন্ধকারের কারণে নিরানন্দ লাগলেও সত্যি সত্যি এলাকাটি দারুণ সুন্দর।

বছরে চারমাস এখানে সূর্য ওঠে না, বাকি সময়গুলোতে ২৪ ঘন্টাই সূর্যের আলো থাকে 

লংইয়ারবিন নামক ছোট্ট শহরেরটি বিশ্বের সবচেয়ে উত্তর-পূর্ব শহর হিসেবে বিবেচিত। সেখানে বছরের প্রায় চার মাস সূর্যের আলো দেখা যায় না। এই শহরে বসবাস করে প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ। প্রায় ২০০০ এর মতো বাড়ি আছে ছোট্ট এই গ্রামে। নরওয়ের লংইয়ারবিনের বাসিন্দাদের মৃত্যু অবৈধ। সেখানে বসবাসরত কোনো মানুষ গ্রামে মারা যেতে পারবে না বলে কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা আছে।

১৯৫০ সাল থেকেই সেখানে মৃত্যু নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদি কোনো মৃত্যু পথযাত্রী থাকেন সেখানে; তাহলে দ্রুত তাকে মূল ভূ-খণ্ড থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। এর কারণ হলো সেখানকার আবহাওয়া। নরওয়ের এই স্থানটি যেহেতু বরফে ঢাকা থাকে বেশিরভাগ সময়ই; তাই সেখানে মৃতদেহগুলো কবর দিলে তা পচে না।

সারাবছর এখানে বরফ থাকার কারণে মৃতদেহ কবর দিলেও পচে না

আর্কটিক বৃত্তের উর্ধ্বে থাকা, সোভালবার্ডের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কখনও কখনও তা কমে দাঁড়ায় ২.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইটে। এ কারণে সেখানে কোনো মৃত ব্যক্তিকে কবর দিলে লাশ পচে না। তাই যদি কোনো ব্যক্তি মরনঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন; তাহলে সেই ভাইরাসও ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে নষ্ট হবে না। ১৯৫০ সালে স্থানীয়রা যখন বিষয়টি বুঝতে পারেন; তখন রোগ ছড়ানোর ভয়ে তারা শহরে মৃতদের কবর দেয়া বন্ধ করে দেয়। তখন থেকেই লংইয়ারবিনে মৃত্যু নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়। 

নব্বইয়ের দশকে গবেষকরা বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯১৮ সালের ফ্লুতে মারা যাওয়া ও সেখানকার বরফে চাপা দেয়া লাশের শরীর থেকে ১৯৯৮ সালে এসেও জীবিত ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে। আর এ কারণেই এখানকার স্থানীয়রা লাশ না পচে যাওয়া নিয়ে বেশ শঙ্কায় থাকেন। কারণ লাশের শরীর থেকেও জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো এলাকায়।

একইভাবে করোনাভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী ভাইরাস ঠান্ডা আবহাওয়াতে দীর্ঘদিন জীবিত থাকে। বরফপ্রধান দেশে মৃতদের কবর হলেও সে লাশ পচে না বরং তা প্রাকৃতিকভাবে মমিতে পরিণত হয়। এ কারণে লংইয়ারবিনের বাসিন্দাদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ থাকা ব্যক্তিদেরকে অন্য শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যদি কেউ মৃত্যুবরণ করে; তাহলে লাশ দ্রুত অন্যত্র দাফন করা হয়। 

মৃতদেহ না পচার কারণে ভাইরাস জীবাণুও নষ্ট হয় না, ফলে এটা অন্য সবার জন্য হুমকি হতে পারে

লংইয়ারবিনে একটি ছোট চিকিৎসাকেন্দ্র আছে, যেটি প্রাথমিক অবস্থায় রোগীদেরকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গুরুতর হলে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়। আর যদি কোনো ব্যক্তি আকস্মিকভাবে লংইয়ারবিনে মারা যান। তাহলে তার লাশ দ্রুত হেলিকপ্টারে করে অন্য শহরের সমাধিস্থলে নিয়ে দাফন করা হয়। 

জন্মের বিষয়টিও নিষিদ্ধ প্রায় একই রকম কারণে। ছোট হাসপাতাল থাকলেও এত অল্প জনসংখ্যার জন্য মাতৃত্বকালীন ভালো কোনো সুবিধা এখানে নেই। প্রসবের সময় যেকোনো ধরনের ঝুঁকি অথবা অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু এড়াতে গর্ভবতী নারীকে পাঠিয়ে দেয়া হয় লংইয়ারবিনের সবচেয়ে কাছের কোনো শহরে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই শুধু তারা শহরে ফিরতে পারেন।

এ শহরে আরও একটি মজার আইন হচ্ছে, এখানে কোনো ধরনের বিড়াল পালারও অনুমতি নেই। বিড়াল যদি কোনো পাখিকে আক্রমণ করে, তবে পাখি কমে যাওয়ার বা বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সে ধরনের ঝুঁকি এড়াতেই সহজ পদ্ধতি হচ্ছে কোনো ধরনের বিড়ালই না পালা। নতুন কোনো পর্যটক বিড়াল না পালার যুক্তি শোনার পর কিছুটা বিস্মিত হন বটে, কিন্তু বুঝতে পারেন শহরের পাশাপাশি এখানকার জীববৈচিত্র্যের জন্য মানুষের ভালোবাসা কতটুকু। এমন অদ্ভুত একটি এলাকায় থাকতে চাইলে কিছুটা ঝুঁকি আর নিয়ম মেনে তো চলতেই হবে। এ এলাকায় প্রায় এক হাজারেরও বেশি পোলার বিয়ার আছে। তারা এই জায়গাকে নিজেদের ঘর বলেই মানে।

মরু অঞ্চলের লংইয়ারবিন স্থানটি বেশ মনোমুগ্ধকর

মরু অঞ্চলের লংইয়ারবিন স্থানটি বেশ মনোমুগ্ধকর। এলাকাবাসীর ঘরগুলো বিভিন্ন রঙের এবং আকর্ষণীয়। সারিবদ্ধভাবে একই উচ্চতার হরেক রঙের বাড়িগুলো দেখলে আপনার মনে ভরে যাবে। বরফে ঢাকা পর্বমালা ও উপত্যকা দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা স্থানটিতে ঘুরতে যান। লংইয়ারবিন অবস্থিত বৃহত্তম দ্বীপ স্পিটসবার্গেন। শীতে সেখানকার আকাশে রাতে নানা রঙের আলো দেখা যায়। যা অরোরা নামে পরিচিতি।

এ শহরের আরও একটি আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে পুরনো কয়লাখনিতে বানানো বীজ ব্যাংক। বিভিন্ন জাতের যত ধরনের গাছ রয়েছে বিশেষ করে যদি কোনো বিলুপ্তপ্রায় গাছের সন্ধান পাওয়া যায়, সেগুলোর বীজ সংগ্রহ করা হয় এই ব্যাংকে। এখানে এখন পর্যন্ত প্রায় আট লাখেরও বেশি ধরনের গাছের বীজ সংরক্ষিত আছে। এ সংখ্যা আরও বাড়ছে। এই ব্যাংক বানানো হয়েছে ভবিষ্যতের যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা নিউক্লিয়ার যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে।

লংইয়ারবিন টিকে আছে পর্বতের গায়ের কয়লাখনির জন্য। এ কারণেই গত শতাব্দী থেকে এখানে গড়ে উঠেছে খনিশিল্প। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শহরটি সাধারণ খনন শহর হিসেবে পরিচিত থাকলেও ধীরে ধীরে এখানে বিভিন্ন ব্যবসায়িক সম্প্রদায় তৈরি হচ্ছে। কয়লাখনি মূল বাণিজ্য হলেও সাম্প্রতিক কয়েক বছরে কয়লার দাম পড়ে যাওয়ায় খনির কাজও কমিয়ে আনা হয়েছে। 

বরফে ঢাকা পর্বমালা ও উপত্যকা দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা স্থানটিতে ঘুরতে যান

লংইয়ারবিনের প্রতিটি অধিবাসীই মানেন এখানকার ভিন্ন ভিন্ন সব ঋতুই আকর্ষণীয়। কারও কাছে ভালো লাগে শীতের অন্ধকার আলো, আবার কারও কাছে মাঝরাতে আকাশে ওঠা সূর্যের উজ্জ্বল আলো। উত্তর মেরুর সবচেয়ে কাছে এ শহরটির অবস্থান হওয়ায় শীতের সময় প্রায় চার মাস এখানে রাত থাকে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ১২০ দিন পর্যন্ত এই এলাকার মানুষের দিন কাটে প্রাকৃতিক দিনের আলো ছাড়া। তখন এই এলাকায় আলাদাভাবে দিন ও রাতের কোনো পার্থক্য বোঝা যায় না। 

সূর্য যেহেতু দেখা যায় না, তবু দিগন্তে তার নীল ও লাল উজ্জ্বল আলোর আভা ছড়িয়ে পড়ায় পুরো পরিবেশ খুব সুন্দর নীলচে এক মোহনীয় আবেশ তৈরি করে। ঘড়ি মেনে যে সময়টুকুকে মেরুর রাত বলা হয়, সে সময়ের শুরু আর শেষ হয় গোধূলি আলো হয়ে। সব মিলিয়ে রাত হলেও লংইয়ারবিন যেকোনো পর্যটককে মোহনীয় করে রাখতে সক্ষম। আবার গ্রীষ্মের সময় মধ্যরাতে যখন সূর্য ওঠে, তখন সপ্তাহের ৭ দিন ২৪ ঘণ্টাই চারপাশ সূর্যের আলোয় আলোকিত থাকে।

ঋতুর বৈপরীত্য লংইয়ারবিনের অধিবাসীর প্রতিদিনের জীবনে ও কাজে প্রচুর প্রভাব ফেলে। যখন চারপাশ আলোকোজ্জ্বল আর রৌদ্রময় থাকে, তখন মানুষ প্রচুর সময় বাইরে কাটায়। আবার যখন শীতের অন্ধকার সময় শুরু হয়, তখন স্থানীয়সহ অতিথিদের মধ্যে সামাজিকতা অনেক বেড়ে যায়। এ সময় বিভিন্ন ধরনের উৎসব, কনসার্ট, খেলাধুলার আয়োজনসহ বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খাবার-দাবারের নানা আয়োজন থাকে। অন্ধকার এই ঋতুতে ক্রিসমাসের সময় পাহাড়ের ওপর মানুষরা বিভিন্ন রঙের টর্চ গায়ে প্যারেড করেন। এই দৃশ্যটি দেখতেও দারুণ লাগে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.