রমজানের শেষ দশক গুরুত্বপূর্ণ যেসব কারণে

দেখতে দেখতে আমাদের কাছ থেকে বিদায়ের হতে চলেছে ইবাদতের বসন্তকাল মাহে রমজান। রমজানের শেষ দশকের সময়গুলো খুবই মূল্যবান। এসময় বেশি বেশি ইবাদতে মশগুল থেকে পুরো বছরের পুঁজি সংগ্রহ রাখা মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। 


এখন যেসব আমল বেশি করে করা যায় তাহাজ্জুদের নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, তওবাহ-ইস্তেগফার, দোয়া-দরুদ এসব অন্যতম। এ ছাড়াও সেহরি ও ইফতারিতে আত্মীয়স্বজন, অভাবী পড়শিদেরও খেয়াল রাখা চাই। রমজানের শেষ দশকে বিশেষ আমলগুলোর অন্যতম হলো এতেকাফ, বেজোড় রাতে শবে কদর তালাশ, তাহাজ্জুদের নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দান, সদকা, বেশি বেশি দোয়া ও তওবা-ইস্তেগফার করা।

ইতিকাফ

পবিত্র রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। জাগতিক সব ধরনের সংস্পর্শ ত্যাগ করে মসজিদে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। পবিত্র কোরআনে সুরা বাকারার ১২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন-‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে (কাবা) তাওয়াফকারীদের জন্য, ইতিকাফকারীদের জন্য ও (সর্বোপরি তার নামে) রুকু-সিজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রাখে।

হজরত আয়েশা (রা.) আরো বলেন, ‘নবী করিম (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ পালন করতেন। তার ওফাতের আগ পর্যন্ত তিনি ইতিকাফ পালন করে গেছেন। তারপর তার পত্নীরাও তা পালন করেছেন। (তিরমিজি: ৮০৮)। 

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এতেকাফ করবে, আল্লাহতায়ালা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন, প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি। (শোয়াবুল ঈমান: ৩৯৬৫)

রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করলে ২৭ রমজান যদি শবে কদর নাও হয়, তবু এ ১০ দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট শবে কদরের ইবাদত এতেকাফে আদায় হয়ে যায় এবং এর ফলে শবে কদরের রাতের ফজিলতও লাভ করা যাবে।

পবিত্র শবে কদর

রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ এবং মহিমান্বিত রজনি হলো শবে কদর। কদরের রাতে অজস্র ধারায় আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। এ রাতে এত অধিকসংখ্যক রহমতের ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করেন যে, সকাল না হওয়া পর্যন্ত এক অনন্য শান্তি বিরাজ করে পৃথিবীতে। শবে কদরের ফজিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সুরায়ে কদরে এরশাদ করেন-নিশ্চয়ই আমি পবিত্র কোরআনুল কারীমকে লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছি। আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হলো হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। উক্ত রজনীতে ফেরেশতাগণ ও জিবরাঈল (আ.) তাদের প্রতিপালকের নির্দেশে প্রত্যেক বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হন এটা শান্তিময় রজনী যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সুরা আল কদর : ১-৫)

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যদি কেউ ঈমানের সঙ্গে সাওয়াব লাভের খাঁটি নিয়তে লাইলাতুল কদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে তবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে। (বোখারি: ৬৭২)

শবে কদরের আমল 

রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে ‘লাইলাতুল কদর’ লাভ করার জন্য রমজানের শেষ দশরাত জাগ্রত থেকে ইবাদতে কাটিয়েছেন এবং উম্মতে মুহাম্মাদীকেও সারা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করার নির্দেশ দিয়েছেন। 

রাসূল (সা.) বলেন, শবে কদরকে নির্দিষ্ট না করার কারণ হচ্ছে যাতে বান্দা কেবল একটি রাত জাগরণ ও কিয়াম করেই যেন ক্ষান্ত না হয়ে যায় এবং সেই রাতের ফজিলতের উপর নির্ভর করে অন্য রাতের ইবাদত ত্যাগ করে না বসে। তাই বান্দার উচিত শেষ দশকের কোন রাতকেই কম গুরুত্ব না দেয়া এবং পুরোটাই ইবাদাতের মাধ্যমে শবে কদর অন্বেষণ করা।

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসূল আমি যদি কদরের রাত সম্পর্কে অবহিত হতে পারি তবে আমি কি করব? তখন রাসূল (সা.) আমাকে এই দুয়া পাঠ করার জন্য বললেন। ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি’। (তিরমিজি: ৩৫১)

লাইলাতুল কদরের ফজিলত অপরিসীম। তাই সারা রাত জাগ্রত থেকে সঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগীতে মনোনিবেশ করা কর্তব্য। বেশি বেশি নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ, সালাতুস তাসবিহ, উমরী কাজা নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দান-সাদকা, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, তাওবা-ইসতেগফার, দুয়া-দুরূদসহ ইত্যাদি নফল আমলের প্রতি মনযোগী হওয়া একান্ত জরুরি।

কিয়ামুল লাইল ও তাহাজ্জুদের নামাজ

কিয়ামুল লাইল ও তাজ্জুদের নামাজে শেষ সময়টুকু কাটানো যেতে পারে। কিয়ামুল লাইল শব্দের অর্থ রাতের নামাজ। তারাবির নামাজ যেমন কিয়ামুল লাইলের মধ্যে পড়ে, তেমনি শেষ রাতে তাহাজ্জুদও সালাতুল লাইলের অন্তর্ভুক্ত।

রমজান মাসের শেষ রাতে সহজেই তাহাজ্জুদের নামাজের আমল করা সম্ভব। সেহরির সময় পানাহারের জন্য ঘুম থেকে সময়মত ওঠে খানাপিনা শেষ করে বাকি সময়টুকু তাহাজ্জুদের নামাজে কাটানো যেতে পারে। ইচ্ছা করলেই তাহাজ্জুদের নামাজের আমলটা সহজে করা যায়। একটু আগেভাগে উঠে দু’চার রাকাত নামাজ পড়া তেমন কষ্টের কিছু নয়, কেবলই ইচ্ছার ব্যাপার।

নারীরাও রান্নার ফাঁকে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে নিতে পারেন। তাহলে তাহাজ্জুদ পড়ার একটি অভ্যাসও গড়ে উঠবে। সারা বছর যাদের ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করতে বেগ পেতে হয়, তারা রমজানে সহজেই তা করতে পারেন। এ সুযোগে রমজানে আগে ওঠার অভ্যাস ধরে রেখে সবসময়ের জন্য এ রীতি বহাল রাখুন, তাহলেই তা অভ্যাসে পরিণত হবে।

পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত 

রমজানে দিনে খাবারের ঝামেলা না থাকায় সকাল বেলায় কাজের ঝামেলাও কম থাকে। সে সময়টাকে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারেন। কোরআন নাজিলের মাস হিসেবে এ সময় কোরআনে কারিমের তিলাওয়াত করা যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-‘রোজা ও কোরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে’। (আহমাদ: হাদিস ৬৬২৬)। 

এ মাসেই যেহেতু কোরআন মজিদ অবতীর্ণ হয়েছে তাই বেশি বেশি কোরআন নিয়েও মশগুল থাকা। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হাদিসে এসেছে, জিব্রাইল (আ.) রমজানে প্রতিরাতে রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং রাসূল (সা.) তাকে কোরআন শোনাতেন। (বোখারি : ১৯০২)। রমজানে যেহেতু প্রতিটি ইবাদতের সওয়াব ৭০ গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়, তাই এ মাসে যথাসাধ্য বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক।

জিকির, দোয়া ও ইস্তেগফার

নাজাতের শেষ দশকে বেশি বেশি করে আল্লাহর জিকির, তাসবিহ, তওবা, ইস্তেগফার ও দোয়া-দরুদ পড়া জরুরি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিন সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর এবং সকাল-বিকাল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা কর। (সুরা আহজাব : ৪১-৪২)।

দোয়া ও মোনাজাত হচ্ছে মুমিনের প্রধান হাতিয়ার

আল্লাহতায়ালা বলেন: ‘মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো এবং সকাল-বিকাল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করো। (সুরা আহজাব: ৪১-৪২)। হাদিস শরিফে দোয়াকে ‘ইবাদতের মগজ’ বলা হয়েছে। অপর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ তায়ালা রমজানের প্রতিদিন ও প্রতিরাতে বহুসংখ্যক লোককে মুক্তিদান করেন এবং প্রত্যেক মুসলমানের একটি দোয়া প্রতিদিন কবুল হয়। 

দোয়া-মোনাজাত ও ইস্তেগফারের পাশাপাশি সহজ-সহজ জিকির ও তাসবিহ পাঠ করেও অধিক সওয়াবের অধিকারী হতে পারি। দুনিয়া ও আখেরাতের নানা সঙ্কট থেকে মুক্তির জন্য এ মোবারক মাসে আল্লাহর দরবারে খাস দিলে দোয়া করলে আমাদের জীবনে কামিয়াবির পথ রচিত হবে। আল্লাহ তায়ালার জিকির এমন এক মজবুত রজ্জু, যা সৃষ্টিকে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। তার সান্নিধ্য লাভের পথ সুগম করে। মানুষকে উত্তম আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে। সরল ও সঠিক পথের ওপর অবিচল রাখে। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম ব্যক্তিকে দিবা-রাত্রি গোপনে-প্রকাশ্যে জিকির করার আদেশ দিয়েছেন।

রমজান মাসে সিয়াম সাধনা, তারাবিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব আমলের পাশাপাশি এসব বিশেষ আমলগুলো করতে পারলে আমলের মাত্রা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। নেকির খাতায় জমা হবে অসংখ্য আমল।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে বেশি বেশি নেক আমলের মাধ্যমে রমজানের বাকি সময়টুকু কাটানোর তাওফিক দান করুন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.