প্রেমের তালায় বন্দি ভালোবাসা!

Odd বাংলা ডেস্ক: রোমান্টিক মানুষদের কাছে প্যারিসের বিকল্প কোনো শহর বোধহয় এই পৃথিবীতে নেই। প্যারিসে ভালোবাসা সম্পর্কিত এমন কিছু ব্যাপার আছে যা এই শহরকে অন্য সব শহর থেকে আলাদা করেছে। এ শহরটি ভালোবাসাকে এমনভাবে লালন করছে যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ভালোবাসার ধ্বংস হবে না। যেখানে প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, ল্যুভর জাদুঘর এবং সর্বদেবতাদের মন্দির বিশ্বের সব অরাজকতা, যুদ্ধ ও নাৎসিদের জঘন্য কার্যক্রমের বিরোধিতা করে এসেছে। সেখানে প্যারিসের পন্ট ডেস আর্টস ব্রিজ ভালোবাসা এবং রোমান্সের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য দিয়ে প্রেমিকদের মন জুড়ে বিরাজ করছে। এখানে প্রেমিক-প্রেমিকারা তাদের ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ তালা ঝুলিয়ে যায়।
কীভাবে লাভ কি-তে ভালোবাসা অমরত্ব পায়?  
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে প্রথমে আপনার অবশ্যই গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড থাকতে হবে। সুন্দর একটি তালায় নিজেদের নাম লিখে একসঙ্গে সেতুর পাশে দাড়িয়ে তালাটি ঝুলিয়ে দিতে হবে। তারপরে চাবিটি সেতুর নিচে প্রবাহিত নদীতে ফেলে দিতে হবে। চাবিটি নদীতে ফেলে দেয়ার ফলে এটি খুঁজে পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। এজন্য প্রেমিকরা মনে করে তাদের প্রেম অমরত্ব লাভ করেছে।

যারা এই কথাগুলো শুনে অবাক হচ্ছেন তাদের একবার ইউরোপ ভ্রমণ করা উচিত। এই প্রেমের গল্পটি ইউরোপের প্রায় সব দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। এটি প্যারিসের প্রথম ধাতব ব্রিজ। ফরাসির প্রথম সম্রাটের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছিল।

কীভাবে লাভ-লক রীতিটি উৎপত্তি হয়?
অনেকেই মনে করতে পারেন যে এই লাভ-লক রীতিটির উৎপত্তি প্যারিস থেকেই শুরু। মজার ব্যাপার হলো রীতিটি সার্বিয়ার ভ্রঞ্জাক্কা বানজা নামে একটি শহরে শুরু হয়েছিল। সেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে এক যুবক ও যুবতী প্রেমে পড়েছিলেন। তারা ওই শহরের লুজুবাভি ব্রিজের ওপর প্রায় প্রতি রাতেই মিলিত হতো। কিন্তু যুবকটি সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পর অন্য কারো প্রেমে পড়ে যায়। এই ঘটনা যুবতী সহ্য করতে না পেরে হৃদরোগে মারা যায়। এরপর থেকেই ওই স্থানে এক গুজব ছড়িয়ে পরে যে, যুবকটির আত্মা ব্রিজটির কাছে কান্না করছে, তালায় তাদের ভালবাসার নাম লিখছেন। ব্রিজের সঙ্গে তালা ঝুলিয়েছেন যেন তাদের ভালোবাসা পূর্ণতার রূপ পায়। সার্বিয়ান কবি দেশানকা মাকসিমোভিচ এই গল্পটি নিয়ে একটি কবিতা লেখার পর ঐতিকাসিকভাবে এটির সূচনা হয়েছিল।
এছাড়াও ধারণা করা হয় প্রেমের লক ব্রিজের বর্তমান তরঙ্গের উৎস ফেডেরিকো মক্সিয়া নামে একক ইতালিয়ান লেখকের কাছ থেকে এসেছে। মোকিয়া ‘আই ওয়ান্ট ইউ’(আমি তোমাকে চাই) নামে একটি বই লিখেছিলেন। বইটিতে রোমের ২১০০ বছর বয়সি পন্টে মিলভিও ব্রিজে একটি প্রদীপ পোস্টে একটি প্রেমের তালা রেখেছিলেন। লেখকের বইটি এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে পরবর্তীতে বইটির ওপর ভিত্তি করে একটি সিনেমা তৈরি করা হয়েছিল। সিনেমাটি প্রকাশের কিছুদিন পরে প্রদীপ পোস্টটি তালার ভারে আংশিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। এ কারণে লোকেরা তাদের তালা অন্য ব্রিজের ওপরে লাগাতো। ব্রিজ রক্ষার্থে রোম সরকার একটি নিয়ম জারি করেছিল যে ব্রিজে কেউ তালা লাগাতে গিয়ে ধরা পড়লে ৫০ ইউরো জরিমানা দিতে হবে। এই ব্যবস্থা গ্রহণের পর ইতালিতে তালা ঝুলানোর প্রথা কমলেও এশিয়াসহ অন্যান্য ইউরোপে এটি ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালে ফ্রান্সে এটি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

একবিংশ শতাব্দীর রোমান্টিক হওয়া
স্বীকৃত স্বভাবের কারণে এই সেতুটি অসংখ্য ফিল্ম এবং টেলিভিশন শোতে প্রদর্শিত হয়েছে। ‘লে পন্ট ডেস আর্টস’ ইউজিন গ্রিন পরিচালিত একটি ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল। চলচ্চিত্রটিতে একটি যুবকের প্রেমের গল্প তুলে ধরা হয়েছিলে। যুবকটি রেকর্ডকৃত বারোক শোক গায় এমন এক যুবতীর মধ্যে তার জীবনের পুরো অর্থটি খুঁজে পেয়েছিলেন। যুবতী পন্ট ডেস আর্টস থেকে আত্মহত্যা করেছিল বলে যুবক তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ব্রিজের সঙ্গে তালা ঝুলিয়ে রাখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এই তালা যতদিন কেউ খুলতে না পারবে ততদিন তার ভালোবাসা তার সঙ্গেই থাকবে। ছবিটি ২০০৪ সালে ৫৭ তম লোকারানো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।

লুই লেটারিয়ার পরিচালিত ২০১৩ সালের হলিউডের হিস্ট অ্যাডভেঞ্চার ফিল্ম ‘এখন তুমি আমাকে দেখ’ তেও এই ব্রিজটিকে দেখানো হয়েছিল। ব্রিজটিতে আলমা ড্র (মেলানিয়া লরেন্ট) ডিলান রোডস (মার্ক রুফালো) এর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আলমা একটি লক এবং একটি চাবি নিয়ে যায় যা ডিলান তৈরি করে, লকটিকে একটি চেইনের বেড়াতে রেখে চাবিটি নদীতে ফেলে দিয়েছিল।

পন্ট ডেস আর্টসের সম্প্রসারণ ও সংকোচন
কয়েক বছরের মধ্যে তালার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পন্ট ডেস আর্টস ব্রিজটির বেড়ার এক অংশ ধসে যায়। দুর্বল চেইন লিঙ্কের বেড়াটি বেশি ভার নিতে না পারার কারণে এমনটি হয়ে থাকে। ফরাসি কর্মকতারা ব্রিজের উপর এ তালা না লাগানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তারা সফল হতে পারেনি। পরবর্তীতে তারা বিস্ময়করভাবে ৪৫ টন ওজনের তালাগুলো নামিয়ে ফেলেন। এ ঘটনার পর প্যারিস সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এর পরিবর্তে প্রেমের ভাস্কর্য ব্রিজ তৈরি করবে। কিন্তু তাদের সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হওয়ার আগে প্যারিসে আরো ১১ টি ব্রিজে প্রেমের এ তালাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে প্রেমের তালাগুলো নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রিজ (শহর কর্মকর্তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে), কোলনের হোহেনজোলারেন ব্রিজ ও জাপানের এনোশিমা দ্বীপে এ লাভ-লক গুলো বেশি দেখা যায়।
১৯৯১ সালে ইউনেস্কো আইফেল টাওয়ারের ইল সেন্ট লুইয়কে ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে পুরো প্যারিসিয়ান রিভারফ্রন্টকে তালিকাভুক্ত করেন। পন্ট ডেস আর্টস এখন এই ইউনেস্কোর বিশ্বের ঐতিহ্যময় স্থানের একটি অংশ।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.