মৃত্যুর ৯ বছর পর সম্রাট বাবরের সমাধি স্থানান্তর করা হয় কাবুলে

Odd বাংলা ডেস্ক: দীর্ঘ ২০ বছর পর আফগানিস্তান দখলে নিয়েছে তালেবান। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে তালেবান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর এখন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। বিশ্বের দৃষ্টি এখন কাবুলের দিকে। আতঙ্কিত লোকজন দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কাবুল বিমানবন্দরের ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়। বিশাল মার্কিন কার্গো বিমানের উপর মানুষকে ঝুলতে, ভেতরে ঝুঁকিপূর্ণ গাদাগাদি করে থাকার চিত্র।

ফিরে দেখা যাক আরো কয়েক শতাব্দী আগে। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের সমাধি বা বাগ- এ-বাবুর অর্থাৎ বাবরের বাগানের। এই বাগ-এ-বাবুরের সঙ্গে আফগানিস্তানের রাজধানী বর্তমান বিশ্বের আলোচিত ও দৃষ্টি নিবদ্ধিত স্থান কাবুলের বিরাট সম্পর্ক রয়েছে। সম্রাট জহির উদ-দিন বাবরের ইচ্ছা অনুযায়ী কাবুলে বাবরকে সমাহিত করা হয়। যদিও এই সমাধিস্থ করা নিয়েও রয়েছে অনেক ঘটনা। 

আফগানিস্তানের ইতিহাস অতি প্রাচীন। উত্তর আফগানিস্তানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছর আগের মনুষ্য বসতির সন্ধান পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকে মধ্য এশিয়ায় আর্য যারা ইরান ও ভারতবর্ষে বসতি স্থাপন করেছিল তারা আসতে শুরু করে। তখন এই এলাকার নাম ছিল আরিয়ানা। এক সময় আলেকজান্ডারও এর পূর্বাঞ্চল দখলে নিয়েছিল। খ্রিস্ট্রিয় ৭ম শতাব্দীতে আরবরা ইসলাম নিয়ে আসে। জহির উদ-দিন মুহম্মদ বাবর ছিলেন মায়ের দিক থেকে তৈমুর লঙের বংশধর। বাবর বা বাবুর ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে কাবুল দখল করে ভারতে গিয়ে মুঘল সম্রাজ্য স্থাপন করেন।

‘মরিয়া বাবর অমর হইয়াছে, নাহি তার কোনো ক্ষয়, পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়।’ কবিতার এই চরণ দুটি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা দিল্লির সম্রাট বাবরকে নিয়ে লেখা। তিনি স্বীয় বীরত্ব ও বিচক্ষণতায় ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত রচনা করেন। একইসঙ্গে প্রাণপ্রিয় পুত্র হুমায়ুনের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শন করে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে স্নেহবৎসল পিতা হিসেবেও স্থাপন করে গেছেন অনন্য নজির।

আফগানিস্তানের চারদিকে ইরান, পাকিস্তান, চীন, তাজিকিস্তান,উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান। অর্থাৎ এসব দেশ বেষ্টিত হয়ে মাঝে আফগানিস্তান। বাবরের জন্ম উজবেকিস্তানে। একজন সুন্নী মুসলিম ছিলেন তিনি। ব্যক্তি জীবনে বাবর ছিলেন একজন কবি, লেখক ও সাহিত্যানুরাগী। বাগান করতে ভীষণ ভালোবাসতেন। তবে কিছু চারিত্রিক অসঙ্গতির কথাও চাউর হয়ে আছে। ১৫৩০ মতান্তরে ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি বাবরের মৃত্যু হলে এরপর সিংহাসনে বসেন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মীর্জা হুমায়ুন। 

বাবরের প্রথম কবর দেয়া হয়েছিল ভারতেই। তবে পরবর্তীতে বাবরের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী আরামবাগ নামক স্থানের চারবাগে( চারবাগ অর্থ চারটা বাগ বা বাগিচা বা বাগান। বাবর এক খণ্ড ভূমি চার ভাগে ভাগ করে এই বাগ তৈরি করেছিলেন বলে একে চারবাগ বলে) স্থানান্তরিত করা হয়। বাবুর বা বাবরের তৈরি প্রচুর বাগান থাকার কারণে জায়গাটাকে কাবুল বলা হতো। ৯ বছর পর বাবুর বা বাবরের ছেলে হুমায়ুন শের শাহ সূরির কাছে পরাজয়ের পর বাবরের স্ত্রী বেগা বেগম বাবরের দেহাবশেষ আফগানিস্তানের কাবুলে বাবরের আরেক সৃষ্টি 'বাগ-ই-বাবুরে'-এ স্থানান্তর করেন। বেগা বেগমের এই সিদ্ধান্তের কারণ আজও অস্পষ্ট। হুমায়ুন যদি সাময়িকভাবে ক্ষমতা না হারাতেন তবে বাবুর আজ ভারতের মাটিতে শুয়ে থাকতেন। 

বাবর কাবুল জয় করেছিলেন ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে। তার মৃত্যু হয় আগ্রায় ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে। তার শেষ ইচ্ছা ছিল কাবুলের যে ৯ থকে ১০ টি অনিন্দ্য সুন্দর বাগান করেছিলেন সেখানেই তাকে সমাহিত করা হোক। তার সেই ইচ্ছা পূরণেই বিধবা স্ত্রী ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে আগ্রা থেকে সমাধি সরিয়ে কাবুলে পাঠান। আবার তাকে সমাধিস্থ করা হয় তার সেই বাগানের মধ্যে। তিনি কাবুলের রুক্ষ্ম, শুষ্ক ভূমিতে বাগান করেছিলেন। নানাবিধ গাছ ও ফুল ফোটানোর পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। ব্যক্তি জীবনে বাবরের ৯ স্ত্রী, ৯ পুত্র ও ৭ কন্যা ছিল। তার স্ত্রীদের মধ্যে কত নম্বর স্ত্রী এই কাজটা করেছিলেন তা জানা যায় নি। নামের শেষে তিনজনের বেগম দেখা গেলেও কোনজন বেগা বেগম তা অজ্ঞাত।

বাবরনামার কোনো এক লেখকের উদ্ধৃতির উপর আমরা কাবুল নামকরণ বিষয়ে সন্তুষ্ট হতে পারি না। তাই অপরাপর সূত্র অনুসন্ধানে সচেষ্ট হই। 'খাইবার গিরিপথের কাছে অবস্থিত বলে কাবুল শহর সামরিক কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এলাকার পাশ দিয়ে প্রবাহিত কাবুল নদী থেকেই স্থানটির নাম কাবুল; সংস্কৃত ভাষায় বলে কুবাহ্। তবে ঐতিহাসিক টলেমির মতে গ্রীকরা তাদের প্রাচীন শহর কাবুলিয়েট ও কাবুরা থেকেই কাবুল নাম দিয়েছে।

অনেকে মনে করেন সংস্কৃত কাম্বুজপুর থেকে কাবুল নামের উৎপত্তি। তবে অনেকে মনে করেন নদীর নাম থেকে কাবুল নামকরণ যথার্থ যৌক্তিক। কেননা পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদের নাম নদী থেকে হবার বহু নজির বিদ্যমান। সংস্কৃতিতে কাম্বুজপুর অর্থাৎ পুর মানে স্থান বা শহর যুক্ত হওয়ায় যেহেতু কাবুলে কোন পুর শব্দ দেখতে পাইনা সে কারণে কাম্বুজপুর থেকে কাবুল নামের উদ্ভব কিঞ্চিত হ্রস্ব মনে হয়। আবার বাবরের বাগ-এ-বাবুর থেকে কাবুল ঠিক পুরো যৌক্তিক মনে হয় না। তবে বাবর যে কাবুলের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য কাজ করেছেন তা সঠিক বলেই নির্ণীত হয়। কাবুলে ১১ রকমের ভাষা প্রচলিত আছে। 

খাইবার গিরিপথের কাছে অবস্থিত বলে প্রাচীন কাল থেকেই কাবুল কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কাবুল প্রাচীন লোকালয় হলেও ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতের মুঘল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর একে তার রাজধানী করেন। পরে বাবর ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর করলেও কাবুল ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ শহর। ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দ প্রথম আফগান আমীর আহমদ শাহ্ কাবুলকে আফগানিস্তানের দুই রাজধানীর একটি বানান। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে কাবুল সেদেশের একমাত্র রাজধানীতে পরিণত হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সেনারা কাবুল দখল করে।

১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত সোভিয়েত সেনারা বা রাশানরা কাবুলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে তালেবানদের দখলে যায়। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুক্ত ফ্রন্ট বা যৌথ বাহিনী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়।' ১৫ আগস্ট ২০২১ তালেবানরা পুনরায় কাবুলের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। বাবরের সমাধি কমপ্লেক্সের সংস্কার করেছিল আগা খান ফাউন্ডেশন। বর্তমানে বাবর সমাধি প্রজেক্ট ও বাগান কাবুল পৌরসভার অধীনে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.