ভৌতিক গল্প: অভিশপ্ত পঞ্চাশ হাজার টাকা



অজিত দাস: এখন দোকানে তেমন কাস্টমারের দেখা নেই। সূর্য প্রায় মাথার উপরে। মনু মিয়া নিজের চায়ের দোকানের বেঞ্চিতেই চিত হয়ে শুয়ে রয়েছেন। হঠাৎ একটা লোক তার পাশে এসে দাঁড়াল। শান্ত কন্ঠে মনু মিয়াকে বলল, এই যে মিয়া ভাই, আপনার ৫০ হাজার টাকা ফেরত দিতে আইছি। কথাটা শুনে মনু মিয়া চমকে শুয়া থেকে উঠে বসলেন। লোকটার দিকে বড় বড় চোখ করে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইলেন তিনি। কিছুটা উত্তেজিত কন্ঠে বললেন, কেডা আপনে? আর কিসের ৫০ হাজার টাকা? এইবার ঐ লোকটা আমতা আমতা করে বলতে লাগল, ইয়ে মানে ভাই, আমি রিক্সা চালাই। গত ৪ দিন আগে ঠিক দুপুরে আপনার চায়ের দোকানে আসি আমি। ঐদিনও আপনে এইভাবেই বেঞ্চিতে শুইয়া ছিলেন। আমি একটা কলা আর রুটি নিলাম। আপনেরে ২০টাকা নোট দিছিলাম। রুটি কলার দাম হইছিল ১৫টাকা। আপনে কইছিলেন নোটটা দোকানের ক্যাশবাক্সে রাইখা ৫টাকা ফেরত নিতে। আপনার ঘুম ধরছে শুয়া থেকে উঠবেন না। আমি ক্যাশবাক্সে টাকা রাখতে গিয়া চমকাই উঠলাম। ক্যাশবাক্সে ৫০০ টাকার নোটের একটা বান্ডেল। এইটা এইভাবে রাইখা আপনে ঘুমাইতাছিলেন। তাই আর লোভ সামলাইতে পারি নাই। টাকাটা নিয়া চইলা গেছিলাম। এখন নিজের ভূল বুঝতে পারছি। 

আমি চোর । টাকাটা রাখেন। আর আমারে মন থিকা মাফ কইরা দেন। কোনো অভিশাপ দিয়া থাকলে তুইলা নেন। মনু মিয়া এতক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। লোকটার হাতে আসলেই ৫০০টাকা নোটের একটা বান্ডেল। মনু মিয়া এবার গলায় যথেষ্ট বিষ্ময় ফুটিয়ে লোকটাকে বললেন, আপনে কী পাগল হইছেন নাকি? এই টাকা আমার না। ৫০০টাকার নোটের বান্ডেল আমি পামু কই? আর থাকলে কী এইখানে বইসা চা বানাইতাম? একটা মুদির দোকান দিয়া দিতাম। এছাড়া এত্তগুলা টাকা আমি ক্যাশবাক্সে রাইখা নিশ্চিন্তে বেঞ্চিতে শুইয়া ঘুমামু কেন? কেডা আপনে মতলব কী? এবার মনসুর আলিও হতভম্ব হয়ে মনু মিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনসুর আলি এবার গলায় কিছুটা করুণা ফুটিয়ে বললেন, এত কথা বুঝি না ভাই। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি আপনার দোকান থিকা চুরি করছি। এখন টাকাটা রাখেন আর আমারে মুক্তি দেন। মনু মিয়া এবার বেশ রেগে বললেন, মজা করার আর জায়গা পান না মিয়া! আপনারে চিনি না, আপনার টাকা নিমু কেন? তার উপর আবার আউলা-যাউলা কথা কইতাছেন। বুঝছি আপনে ধান্ধাবাজ। আমারে টাকা ধরাইয়া বিপদে ফালাইতাছেন! এক্ষুণি আমার সামনে থিকা যান! নাইলে কিন্তু লোক ডাইকা পুলিশে দিমু। রিক্সাওয়ালা মনসুর আলির কোনো কথাই আর মনু মিয়া শুনেন না। তাকে ধমকে দোকানের সামনে থেকে তাঁড়িয়ে দেন তিনি। মনসুর আলি টাকার বান্ডেলটা নিজের লুঙ্গির গোছায় বেধে রাস্তায় হাঁটা দেন। মনসুর আলির মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে। চাওয়ালা লোকটার এই আচরণে তিনি হতভম্ব এবং বিস্মীত। মনসুর আলির স্পষ্ট মনে আছে এই লোকটার চায়ের দোকান থেকেই ৪ দিন আগে তিনি এই টাকার বান্ডেলটা চুরি করেছিলেন। তাহলে লোকটা এইসব কিছু অস্বীকার করছে কেন! টাকাটা লোকটার না হলেও এতগুলো টাকা দেখে লোকটার উচিত ছিল টাকা গুলো লুফে নেওয়া। লোকটা তাও করল না। মনসুর আলি হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ চলে এসেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না এইটাকা গুলো নিয়ে এখন তিনি কী করবেন! এই ৫০ হাজার টাকা কোনো সাধারণ টাকা না! রহস্যময় টাকা। ঐদিন চায়ের দোকান থেকে টাকাগুলো নিয়ে বাড়িতে ফেরার পর থেকে এই পর্যন্ত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটেছে মনসুর আলির সাথে। ঐদিন এই টাকাগুলো নিয়ে বাড়িতে গিয়েই দেখলেন তার দুই ছেলেমেয়ে ভয়ংকর রকমের অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে রয়েছে। তার স্ত্রী তাদের মাথায় পানি ঢালছেন। এইতো সকাল বেলা পরিপুর্ণ সুস্থ দুইজন ছেলেমেয়েকে বাড়িতে রেখে তিনি রিক্সাচালাতে গেলেন। কিন্তু এখন আর তার ছেলে মেয়েদের চেহারা চেনা যাচ্ছে না। দুজনের চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। দেখে মনে হয় কতদিন ঘুমায়নি। মুখ সহ পুরো শরীর শুকিয়ে গেছে। দেখে মনে হয় কত দিন না খেয়ে আছে! তার স্ত্রী তাকে বললেন, আজ দুপুরের আগেও পুরোপুরি সুস্থ ছিল তারা। দুপুরে হঠাৎ করে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়। এরপর থেকে এই অবস্থা। হঠাৎ শরীর জ্বরে পুড়ে যায় আবার ঠান্ডা হয়ে যায়। মনসুর আলি সেদিন তার স্ত্রীকে এই টাকার কথা বলেন নি। তিনি টাকাগুলো পেয়ে যতটা আনন্দ পেয়েছিলেন তার ছেলেমেয়েদের অসুস্থ অবস্থায় দেখে তার চায়ে বেশি কষ্ট পেলেন। তাও তিনি টাকা গুলো গুনে দেখলেন। ঠিক ৫০ হাজার টাকা রয়েছে বান্ডেলটিতে। মনসুর আলি সেখান থেকে ২ হাজার টাকা নিয়ে বাকি টাকা ঘরের এক বাক্সে লুকিয়ে রাখলেন। তার বাচ্চাদের ডাক্তার খানায় নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। টাকা যেহেতু আছে তাই একজন ডাক্তারকে তিনি নিয়ে এলেন বাড়িতে। ডাক্তারকে যখন তারা বললেন, এরা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেছে। ডাক্তার অবাক হলেন এবং বললেন, হঠাৎ করে শিশু দুটো এতোটা অসুস্থ হতে পারে না। এদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে এদের ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয় না অনেক দিন ধরে। এদের ঘুমেও সমস্যা। আপনারা এদের ঠিকমতো যত্ন নেন না। এই কিছু ভিটামিন লিখে দিচ্ছি আর ফলমূল এনে খাওয়াবেন। শরীরটা অত্যন্ত দুর্বল এদের। ডাক্তার চলে গেল। মনসুর আলি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না তার ছেলে মেয়ে হঠাৎ করে এতটা শুকিয়ে গেল কীভাবে? সকালেইতো কত সুন্দর ছিল! ডাক্তারের কথামতো ভিটামিন আর ফলমূলও আনলেন তিনি। তবে এইগুলো খেতে পারল না তার সন্তানেরা। একটু মুখে দিতেই বমি করে ফেলে দিচ্ছে। শরীর আরও শুকিয়ে যাচ্ছে। মনসুর আলির সন্দেহ হলো এদের জ্বীনে ধরেছে। কবিরাজকে দিয়ে তাবিজ পড়িয়ে আনল। কিন্তু সেই তাবিজেও কাজ হলো না। তার সন্তানেরা আরও বেশি অসুস্থ হচ্ছে। মনসুর আলি কয়দিন রিক্সা নিয়েই বের হতে পারলেন না। সেই বান্ডেল থেকে ৪-৫ হাজার টাকা তার খরচ করা শেষ হয়ে গেছে। মনসুর আলি সেই টাকার বান্ডেলটা গুণে দেখতে নিল বাকি কত টাকা রয়েছে এখন। মনসুর আলি টাকা গুণে হতভম্ব হয়ে গেলেন।

 বান্ডেলে রয়েছে ৫০ হাজার টাকা। সে আরও কয়েক বার টাকা গুনল। হ্যা ৫০ হাজার টাকাইতো আছে। কিন্তু সে তো এখান থেকে অনেকগুলো টাকা খরচ করেছে। এখনতো টাকা কম থাকার কথা এখানে। মনসুর আলির মনে সন্দেহ জাগল। এই টাকা কোনো সাধারণ টাকা না। এই টাকা চুরি করা টাকা। এই টাকা সে চুরি করেছে এক বৃদ্ধ চাওয়ালার কাছ থেকে। মনসুর আলির এখন মনে পড়ছে এই টাকাটা নিয়ে এই বাড়িতে আসার পর থেকেই যত ঝামেলা শুরু হয়েছে। তার সন্তানেরা অসুস্থ হয়েছে। হয়তো সেই বৃদ্ধ লোকটার অনেক কষ্টের টাকা এটা। তাই টাকা চুরির পর লোকটা তাকে অভিশাপ দিয়েছে। তাই এখন তার পরিবারের এই অবস্থা। মনসুর আলি অনুতপ্ত হলেন। তিনি টাকার বান্ডেলটা নিয়ে আবার সেই চাওয়ালার কাছে গেলেন। কিন্তু চাওয়ালার আচারণে তিনি আবার হতভম্ব হয়ে গেলেন। চাওয়ালা তাকে চিনতে পারলেন না। এবং এমন ভাব করলেন যেন টাকাটা তার নয়। মনসুর আলি চিন্তিত মুখ করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না টাকাগুলো দিয়ে এখন কী করবেন। এইগুলো কোনো সাধারণ টাকা নয়। এইগুলো নিয়ে কিছুতেই বাড়িতে ফেরা যাবে না। মনসুর আলি বাকিটা সময় রাস্তায় রাস্তায় হাঁটলেন। এশারের আজানের পর একটা নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলেন। এই রাস্তাটা সন্ধার পরেই নির্জন হয়ে যায়। রাস্তাটা ভালো না। ছিনতাইকারী, পকেটমার, চোর-ডাকাতে ভরা। তবে মনসুর আলি হাঁটছেন অভয়ে। সারাদিনে এই টাকাগুলো কাউকে দেওয়ার মতো সাহস করতে পারেন নি তিনি। এই রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটলে কেউ না কেউ ছুড়ি হাতে তার সামনে এসে দাঁড়াবে। মনসুর আলি তখনি ভয় পাওয়ার ভান করে টাকাটা তাকে দিয়ে দিবেন। ঝামেলা মুক্ত। তিনি অনেকটা পথ হেঁটে এলেন। এখনও কেউ তাকে ধরছে না। তার মনে পড়ে সারাদিন শেষে ৫০০টাকা উপার্জন হওয়ার পর এই রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তার বুক ধক ধক করে কাঁপত। দুই-একবার তাদের মুখোমুখিও হয়েছিলেন। অথচ আজ এতগুলো টাকা নিয়ে হাঁটছেন তার মনে কোনো ভয় নেই। মনসুর আলি ভাবলেন তার লুঙ্গি আর শার্ট দেখে হয়তো তারা বিভ্রান্ত হচ্ছে। তাই তিনি টাকা হাতে নিয়ে গুণতে গুণতে রাস্তা ধরে এগোতে লাগলেন। এবার তার কিছুটা ভয় লাগছে। তার মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ তার পিঠে ছুরি বসিয়ে দিবে। মনসুর আলিকে অবাক করে দিয়ে তার সামনে একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাড়াল। তিনি টাকা হাতেই হা করে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। গাড়িটা থেকে ফর্সা করে মধ্যবয়সী পুলিশের ড্রেস পরা একটা লোক পিস্তল হাতে বের হলেন। মনসুর আলির সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কয়েকবার পর্যবেক্ষণ করলেন। এরপর কিছুটা রাগি কন্ঠে মনসুর আলিকে বললেন, কী রে শালা? আমার এলাকায় ছিনতাই? তাও এতগুলা টাকা? কোথা থিকা ছিনতাই করছিস? কারে খুন কইরা টাকা নিছিস? লাশ কই ফেলছিস? কথাগুলো শুনে মনসুর আলির গলা শুকিয়ে গেল। সে টাকা গুলো ছিনতাই করেনি। করেছে চুরি। কিন্তু চুরির কথাও বলা যাবে না পুলিশের সামনে। তাই তিনি আমতা আমতা করে বললেন, খুন করব কেন স্যার! আমি গরিব মানুষ। এইটা আমার অনেক কষ্টের টাকা। গ্রামে গেছিলাম। জায়গা বেইচা টাকা নিয়া শহরে ফিরলাম। এইবার সেই পুলিশটা আরও রেগে গেলেন। বললেন, মিথ্যা বলার আর জায়গা পাস না? আমারে দেইখা তোর বেয়াক্কেল মনে হয়? তোর কষ্টের টাকা হইলে এই নির্জন রাস্তা দিয়া এইভাবে গুনতে গুনতে যাইতি? চল বেটা থানায়। হতভম্ব মনসুর আলিকে হাতকড়া পড়িয়ে থানায় আনা হলো। সারারাত তিনি লকাপে থাকলেন। নিজের সন্তান এবং স্ত্রীকে নিয়ে সারারাত দুঃশ্চিন্তা করলেন। একেতো তার সন্তানেরা অসুস্থ তার উপর তার স্ত্রীকে তিনি কিছু না জানিয়েই বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। এইযে তিনি জেলে এটাও সে জানে না। সেও হয়তো প্রচুর দুঃশ্চিন্তা করছে। সকাল হতেই তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে থানায় দেখে তিনি বেশ অবাক হলেন। তার চোখে পানি চলে এলো। তিনি ভাবছেন এটা স্বপ্ন নাতো। তার দুই সন্তানকেই আগের মতো সুস্থ দেখাচ্ছে। তিনি বিস্মীত কন্ঠে তার স্ত্রীকে বললেন,তোমরা এইখানে? তোমরা জানলা কেমনে আমি জেলে? আর বাবুগো অসুখ দেখি শেষ। তার স্ত্রী বললেন, আইজ সকালে একটা লোক আইছিল বাড়িতে। তোমার লগে নাকি রিক্সা চালায়। সে গত রাইতে থানায় জিডি করতে আইসা তোমারে দেখছে। আর গতকাল রাইতে হঠাৎ কইরাই এগোর জ্বর গেল গা। শরীরও আবার আগের মতো হইয়া গেছে। কেমনে হইল বুঝলাম না। জ্বীন মনে হয় ছুটছে। মনসুর আলি আনন্দে আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। তার সন্তানেরা সুস্থ আছে এর চেয়ে আনন্দের তার কাছে আর কিছুই নেই। তিনি তার স্ত্রীকে চলে যেতে বললেন এবং চিন্তা না করতে বললেন। মনসুর আলি জেলে চুপচাপ বসে আছেন। তার এখন জেলখানা টাকেও বেহেশত লাগছে। তিনি এখন নিশ্চিত ঐ ৫০ হাজার টাকাই অভিশপ্ত। টাকাটা যেই গতরাতে পুলিশ নিয়েছে তারপর থেকে তার সন্তানেরা সুস্থ হয়ে গেছে। এখন মরেও শান্তি। পরের দুই দিনও মনসুর আলি থানার হাজতে রইলেন। খাবারের সময়ে তাকে খাবার দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই টাকা প্রসঙ্গে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হচ্ছে না এখনও। যেই পুলিশ অফিসার তাকে থানায় নিয়ে এসেছিলেন তিনিও তাকে আর দেখতে আসেন নি। এরমধ্যে তার স্ত্রী সন্তানেরা কয়েকবার তার সাথে দেখা করতে এসেছে। সব মিলিয়ে তার হাজতে থাকতে খারাপ লাগছে না। এটা অপ্রত্যাশিত। আরও ২ দিন পর সকালে মনসুর আলির ঘুম ভাঙল একজন পুলিশ অফিসারের ডাকে। ঘুম ঘুম চোখে তাকালেন তিনি। প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে চিনতে পারলেন এই পুলিশ অফিসারই তাকে থানায় ধরে নিয়ে এসেছিল। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ জাগল এখন হয়তো তাকে মারধর করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাকে অবাক করে দিয়ে পুলিশ অফিসারটা হাজতের মেঝেতে বসে পড়লেন। করুণ মুখ করে মনসুর আলিকে বললেন, আমি এস.আই ইকবাল। আমাকে মাফ করে দিয়েন ভাই। মন থিকা মাফ কইরা দিয়েন ভাই। কোনো অভিশাপ দিয়া থাকলে তুইলা নেন ভাই। খুবই বিপদে আছি। পুলিশ অফিসারের হঠাৎ এই ব্যবহারে বিস্মীত হলেন মনসুর। কিছু না বোঝায় কৌতুহলী চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এস.আই ইকবাল একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বলতে লাগলেন, আমি বুঝতে পারছি ভাই। আপনি ঐদিন সত্য কথাই বলেছিলেন। ঐ টাকা আপনার কষ্টের টাকা ছিল।

 আমি ঐদিন আপনারে জোর করে থানায় নিয়ে আসলাম। আর ঐ ৫০ হাজার টাকা থানায় না জমা দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলাম। লোভ ভাই লোভ। ঐ টাকাটাতে আপনার অভিশাপ লাগছে। টাকাটা নিয়া বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই আমার পরিবারে অঘটন ঘটল। আমার ৩ বছর বয়সের মেয়ে অহনা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেল। হঠাৎ করে জ্বর আসে আবার সেড়ে যায়, আবার আসে। শরীরও শুকিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার বলছে অনেকদিন ধরে খাবারের অভাবে আর ঘুমের অভাবে এসব হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ করে কেন এমন হলো? ডাক্তার কবিরাজ সব দেখাইলাম তাও সুস্থ হচ্ছে না মেয়েটা। আপনার টাকার অভিশাপ লাগছে। টাকাটা রাখেন আর আপনি আমাকে মন থেকে মাফ করে দেন। আমার একটাই মেয়ে। এতটুকু বলেই এস.আই ইকবাল পকেট থেকে সেই টাকার বান্ডেলটা বের করে মনসুর আলির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মনসুর আলি সেই টাকার বান্ডেলটা দেখে আঁতকে উঠলেন। ভয়ে তার শরীর জমতে শুরু করল। বড় বড় চোখ করে তিনি টাকার বান্ডেলটার দিকে তাকিয়ে রইলেন তার পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। তাকে এতটা ভয়ে অস্থির হতে দেখে এস.আই ইকবালও অবাক হলেন। মনসুর আলি ভয়ে মাথা নিচু করে কাঁদতে শুরু করলেন। মনসুর আলি পুরো ঘটনাটা এস.আই ইকবালকে খুলে বললেন। ইকবাল প্রথমে ঘটনাটা বিশ্বাস করতে চাইলেন না। কিন্তু তার বিশ্বাস করা ছাড়া আর উপায়ও ছিল না। ঘটনাটাতো অলৌকিক বটেই। তা না হলে তার মেয়ে হঠাৎ করে এতটা অসুস্থ হবে কেন। এস.আই ইকবাল এবং মনসুর আলি সেই চায়ের দোকানের মনু মিয়ার কাছে গেলেন এই ৫০ হাজার টাকার রহস্য জানার জন্য। মনু মিয়া প্রথমে ঘটনাটা অস্বীকার করলেও পরে পুলিশী ভয়ে সমস্ত ঘটনাটা খুলে বলেন তাদের। মনু মিয়া বলেন, ঘটনাটা বেশ কিছুদিন আগের। আমি বাজারে গেছিলাম দোকানের জন্য কিছু বাজার করতে। বাজার শেষে সি.এন.জি কইরা ফিরতাছিলাম। 

প্রায় এখানকার সি.এন.জি স্ট্যান্ডে পৌছে গেছিলাম। হঠাৎ দেখলাম আমার পাশের সিটে একটা লাল কাপড়ের ব্যাগ পইড়া আছে। আমার পাশে যেই লোকটা বইছিল সে কিছুক্ষণ আগেই নাইমা গেছে। ভাবলাম ভূল কইরা ব্যাগটা ফালাই গেছে। ব্যাগটা খুলতেই দেখলাম এই টাকার বান্ডেলটা। আমিতো অবাক। টাকাটা নিয়া বাড়িতে ফিরলাম। আমার বাড়িতে আমার স্ত্রী, এক মাইয়া আর এক নাতিন থাকে। অভাবের সংসার। ভাবলাম এইবার একটা মুদির দোকান দিব। কিন্তু বাড়িতে ফিরতেই দেখলাম নাতিন ভয়ংকর অসুস্থ। এক দিনে শুকাইয়া প্রায় কাঠ। জ্বর আসে যায়। কত ডাক্তার দেখাইলাম কিছুই হইল না। এই বান্ডেলটার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে স্যার। এইখান থিকা যত টাকাই খরচ করা হোক টাকা কমে না। ৫০ হাজার টাকাই থাকে। যত বেশি টাকা খরচ করলাম তত আমার নাতিন বেশি অসুস্থ হইতে থাকল। পরে বুঝলাম এই টাকাতেই সমস্যা। টাকার আসল মালিকরেতো ফেরত দেওয়া সম্ভব না। টাকা এতিম খানায় দান কইরা দেই। তখন ঘটল আবার আরেক কান্ড। আমি ভালো কইরা টাকাটা পকেটে নিয়া এতিম খানায় গেলাম। টাকাটা যে পাওয়া টাকা এটা তাদের বলি নাই। হুজুর দানের কথা শুনে খুশি হলেন। খাতির যত্ন করলেন। যেই টাকাটা দিতে যাব দেখি পকেটে টাকা নাই। কী এক বেইজ্জতী কারবার! মাথা নিচু কইরা রাস্তায় হাঁটা দিলাম। হঠাৎ দেখি টাকাটা পকেটেই। অথচ! তখন রাগে টাকার বান্ডেলটা ছুইড়া ফালাইলাম রাস্তার পাশের খাদে। বাড়িতে ফিরা দেখি নাতিন আরও অসুস্থ। মরে মরে ভাব। বাড়িতে নাই বাজার। তাই দোকান খুললাম। দোকান খুইলা দেখি সেই বান্ডেলটা আমার ক্যাশবাক্সে। কিছুই বুঝতাছিলাম না টাকাটার পিছু কেমনে ছাড়াই। এরপর থিকা রোজ দুপুরে ক্যাশবাক্স খোলা রাইখা এই বেঞ্চিতে শুইয়া থাকি। অনেকে টাকা দেখলেও কেউ টাকা নেওয়ার সাহস পায় না। এই রিক্সাওয়ালা ভাই টাকাটা নিল। অবাক কারবার ঐদিন বাড়িতে ফিরা দেখি আমার নাতিন আগের মতো সুস্থ! এস.আই ইকবাল সেই লাল ব্যাগে টাকার বান্ডেলটা ঢুকালেন। কঠিন চোখে তাকালেন মনু মিয়া এবং মনসুর আলির দিকে। এরপর বললেন, তোমরা দুজনে ঝামেলা বাঁচিয়ে আমার ঘাঁড়ে চাপিয়ে দিলে? তোমাদের জন্য আমার মেয়ে আজ অসুস্থ। 

এখন এই টাকার ব্যাগটা তোমাদের দুজনের একজনকে নিতে হবে। আমাকে ঝামেলা মুক্ত কর। নাহলে খবর আছে তোমাদের। কথাটা শোনার পর বড় বড় চোখ করে মনসুর আলি এবং মনু মিয়া একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। এরপর দে ছুট। দুইজন দুই থিকে ছুটল। তাদের আর পাওয়া যাবে না। এস.আই ইকবাল বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন। টাকার ব্যাগটা হাতে রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটলেন। একটা হোটেলে গিয়ে ৩ কাপ চা খেলেন। এরপর বাড়িতে ফিরতেই দেখলেন তার মেয়ে আগের মতো সুস্থ। ছুটে বেড়াচ্ছে পুরো বাড়ি। ইকবালের মাথার উপর থেকে একটা বড় বোঝা নামল। টাকার ব্যাগটা তিনি হোটেলে ফেলে এসেছেন। কে যানে এখন টাকার বান্ডেলটা আবার কার বাড়িতে যাবে। এই অভিশাপের শুরু কোথা থেকে, এই পর্যন্ত কয়টা পরিবার ঘুরে টাকাটা তার কাছে এসেছে, আর কয়টা পরিবারে ঘুরবে এই টাকাটা কিছুই জানেন না ইকবাল। এই অভিশাপের শেষ কোথায়?
Blogger দ্বারা পরিচালিত.