ভৌতিক গল্প: ভয়


রিয়াজ কামাল হাসান: আমি রিয়াজ হাসান। কয়েকদিন হয় চাকরি পেয়েছি। বেতনের অ্যাডভান্স টাকা পেয়েই বাড়িভাড়া যেটা দু মাস বাকি পড়েছিল, সেটা শোধ করে দিয়েছি। এক কথায় লাথি মেরে বেরিয়ে এসেছি। বাকি মাস টানাটানি যাবে, কিন্তু কী আর করা? হোটেল থেকে খাবার আসে আমার, সেখানেও বাকি পড়েছে। নতুন বাড়িটা পেতে কম কষ্ট হয়নি। ব্যাচেলর হলে বাড়িভাড়া পেতে কী কষ্ট, ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। আমার দুমাস ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে যেমনতেমন হোক একটা বাড়ি খুঁজে পেতে। কেউ দিতে চায় না। কোথাও তো সরাসরি লেখা থাকে, “ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হইবে না।” কোথাও সেটা লেখা থাকে না, কিন্তু কথা বলতে গেলে প্রথম কথা শুনেই পত্রপাঠ বিদায় করে দেয়। কেউ কেউ তো আঁতকে ওঠে, মুখ দুদিকে ছড়িয়ে বলে, “ব্যাচেলর?” যেন আমি মানুষ না, ডাস্টবিন থেকে উঠে আসা কোন ঘেয়ো কুকুর। একদিন তো আর সহ্য হয় নি। আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম, মাথা অল্পতেই গরম হয়ে যাবার কথা, কিন্তু অনেকদিন ধরে গালিগালাজ সহ্য করেছি। মুখ খিস্তি করে একটা গাল দিলাম, তারপর বললাম, তোর মেয়েকে তো ব্যাচেলরের সাথেই বিয়ে দিবি। তারপরই আমি আর হাসান ভোঁ দৌড়। ধরতে পারলে একটা মারও মাটিতে পড়তো না, এটা নিশ্চিত। পেছনে এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়েছিলাম, দেখি, ব্যাটার মুখ বাংলা পাঁচের মতো হয়ে গেছে। আমি হাল ছেড়ে দিলেও হাসান ছাড়েনি। ওর মতো নাছোড়বান্দা পাবলিক কমই আছে, অন্তত আমি এরকম আর একটাও দেখি নি। বাসা সে খুঁজে বের করবেই, আমাকে কথা দিয়েছিল। ছোঁড়া চালু মাল, এটা স্বীকার করতেই হবে। সেই সাথে পরোপকারী, অন্যের দরকারে জান দিয়ে দেয়। আমার তখন মেলা সমস্যা, থাকার জায়গা নেই, যে আত্মীয়ের বাড়ি থাকছি, সেখান থেকে অষ্টপ্রহর তাড়া দিচ্ছে, টাকা দিয়ে থাকছি, তাতেও তাদের সমস্যা, কারণ তাদের ঘরে উপযুক্ত মেয়ে আছে, আমি সেখানে ঘাঁটি গেড়েছি, তা তাদের পছন্দ নয়, আপদ বিদায় হলেই বাঁচে। আবার তখন নেই চাকরিটাও, কী যে করি ভেবে মাথা চব্বিশ ঘণ্টা একশো পাওয়ারের বাতির মতো গরম হয়ে থাকতো। অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়, একটা কথা আছে। 

আমার ভাগ্যেও কোন শিকেই ছিঁড়ছিল না। যেই বাসাতেই যাই, দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়, আর একটার পর একটা ইন্টারভিউতে আউট হয়ে যাচ্ছি। চারটা টিউশনি ছিল বলে খেয়েপরে ছিলাম, নইলে থালা নিয়ে রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোন গতি ছিল? এক ইন্টারভিউতে তো মজা হয়েছিল, বলা ছিল বেতন আলোচনা সাপেক্ষে। সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিলাম ঠিকঠিক, কোনটা ফসকায় নি। তারপর বেতনের কথা উঠলো। আমাকে জিজ্ঞেস করা হল, আমার কী করে চলে। বললাম। জিজ্ঞেস করা হল, আয় কত? এখানেই তো ভুল করলাম। মুখ ফসকে আসল আয় বলে ফেললাম। শুনে তাঁদের মুখ শুকিয়ে গেল, কারণ আমার টিউশনির আয়ই বেতনের চেয়ে বেশি। মনে মনে নিজের চুল ছিঁড়ছি তখন। মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তাঁরা আমাকে বিদায় করলেন। উহ, কী সব দিন গেছে এক একটা। তবে ভাগ্য যখন ভাল হয়, তখন সবদিক থেকেই ভাল হওয়া শুরু করে। যেদিন এই না-শহর, না-গ্রাম জায়গায় হাসান আমার জন্য বাসা খুঁজে বের করলো, সেদিনই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে এসেছে। বন্ধু মহলে কঞ্জুস বলে আমার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল, কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে হাসানকে সেদিন গরুর চাপ আর নানরুটি খাইয়ে ফেললাম। কেমন বাড়ি পেয়েছে, কী সমাচার, কিচ্ছু শুনতে চাইলাম না, আত্মীয়ের বাড়ি থেকে গটগট করে লোটাকম্বল নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

সেটাই কি ছিল আমার ভুল?

আগেই বলেছি, না শহর, না গ্রাম। এমন একটা জায়গা, যেখানে রাত্তিরে শেয়াল ডাকে, এঁদো পুকুরে মাছ ঘাই দেয়, আবার হুশহুশ করে ট্রেন চলে যাবার শব্দ বাসা থেকেই শোনা যায়। আমি একা মানুষ, বলাই বাহুল্য। জনমানুষ নেই, ছোট্ট একতলা বাসায় আমি একা থাকবো। বাড়িটা যে রাজপ্রাসাদ নয়, সেটা আর বলতে হয় না। কিন্তু আমার জন্য তখন এটাই সাতমহল। আর যাই হোক, মাথার ওপর পাকা ছাদ আছে, পকেটে নগদ টাকা। মন ভাল হওয়ার জন্য আমার মতো একজন নিম্নবিত্ত ঘরের একজন যুবকের আর কী চাই? হাসান কয়েক ঘণ্টা থাকলো। মালপত্র আমরাই টানাটানি করে সব গুছিয়ে নিলাম। হোটেল থেকেই খাবার আনা হয়েছে, সৌভাগ্যক্রমে গ্যাস আছে, পানি গরম করে গোসল করে নেয়া গেল। ঘর মাত্র দুটো, তাতে কী? মেসে থাকা যেত, কিন্তু আমি গরীব মানুষ হলে কী হবে, আমার এইটুকু শৌখিনতা এখনো বজায় রয়েছে, কলেজে ওঠার পর থেকে আমি মানুষের সাথে লাগালাগি করে থাকতে পারি না। সেজন্যেই তো এত ভোগান্তি। একা থাকতে পারলে অন্য অসুবিধা থাকলেও স্বাধীনতা থাকে, যখন যা খুশি করা যায়। যখন খুশি বাসায় ফেরা যায়, সেকেন্ড শো সিনেমা দেখে ফিরলেও খাবার পাওয়া যাবে না, সেই ভয়টা থাকে না। আর মেসের মানুষজন একেকজন হয় একেকরকম। একেকজন নেশা-ভাং করে, একজন তো থু থু ফেলত বিছানার চাদরের নিচে, দেখে সেদিনই চলে এসেছি। তারচেয়ে একা থাকা হাজারগুণে ভালো। হাসানের বাড়ি আছে, পরিবার আছে, আমাকে ওর সাথে থাকতেও বলেছিল, কিন্তু আমার তো একটা সম্মান আছে। স্রেফ না করে দিয়েছি। ঢাকায় আমার বলতে গেলে তেমন কেউ নেই, সবসময় এভাবে চলতেই ভাল লাগে। দুজন মিলে বাসাটার এদিক ওদিক একটু ঘুরে দেখলাম। শহরের মধ্যে নয়, তাই এতটা জায়গা চারিদিকে ফাঁকা রাখার বিলাসিতা করতে পেরেছেন বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। এখানে থাকেন না তিনি, থাকেন এখান থেকে অনেক দূরে। সেখানে তাঁর আরও পাঁচখানা বাড়ি আছে, তাঁর মধ্যে একটাতে তাঁর কেয়ারটেকারের কাছে মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে ভাড়া দিয়ে আসতে হবে। একসময় হয়তো এই বাড়িটাকে বড় করে বানানোর প্ল্যান ছিল, কিন্তু আর করা হয়নি। ছাদ থেকে রড বের হয়ে আছে। সারা বাড়ি ময়লা দিয়ে ভর্তি। সামনে একটা নামকাওয়াস্তে গেট আছে, আছে নিচু দেয়াল, টপকেই ঢুকে পড়তে পারবে যে কেউ। তবে আমার সে ভয় নেই, আমার কাছে নেয়ার মতো কিচ্ছুটি নেই। দেয়ালগুলোতে শ্যাওলা পড়েছে। গাছগুলোতে মালির হাত পড়েনি কখনোই, একনজর দেখলেই বোঝা যায়। আশেপাশে বাড়িঘর নেই, আছে খানিকটা দূরে। দোকানপাট তার চেয়েও দূরে। তবে আমার বাজারঘাটের সমস্যা নেই, খাওয়াদাওয়া করি বাইরে, তাই ভয় পেলাম না। বাড়িটা গাছপালায় ভর্তি, ভালোই লাগলো দেখে। আছে ফলের গাছ, কাঁঠাল আর আম। কিছু ফুলগাছও আছে, অযত্নেই বড় হয়ে উঠেছে, কয়েকটা তো রীতিমতো ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া। কে জানে কী গাছ। আর গাছের চেয়ে বেশি আছে আগাছা, পরগাছা। গাছগুলোর গা বেয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে। জবা, হাসনাহেনা, ম্যাগনোলিয়া আর বাগানবিলাস চিনতে পারলাম। আছে ক্যাকটাস, কাঁটাঝোপ বলাই ঠিক হবে। গাছগুলো সবদিক থেকে ঘিরে রেখেছে বাড়িটাকে, দিনেদুপুরেই আঁধার জমে আছে। দেয়ালের কয়েক জায়গা ভেদ করে বেরিয়েছে পাকুড় গাছের চারা। ঘুলঘুলির কাছে বাসা বেঁধেছে বুনো কবুতর। ছাদে ওঠার সিঁড়িও আছে, ছাদটা যেমন নোংরা তেমন পিচ্ছিল। তবে কিছু দেখেই আমার মন খারাপ হল না, থাকার জায়গা পাওয়ার আনন্দে আমি তখন বিহ্বল। সব গুছগাছ করে দিয়ে হাসান বিদায় নিল। একা হয়ে পড়লাম আমি। এমন কিছু আহামরি বাড়ি নয় যে চারিদিকে তাকিয়ে দেখবো, তারচেয়ে একটু গড়িয়ে নেয়া যাক। রাত তখন দশটার কিছু বেশি। দরজা লাগিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম আমি। সবসময় একা থাকি আমি, নির্জনবাস আমার কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু আজ কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো। কেন এমন হচ্ছে কে জানে? আমি সাহসী মানুষ, নিজের কাছে অন্তত তাই দাবী করি। ভয় আমার ধাতে নেই। ছোটবেলা থেকে ভূতের গল্প শুনে বড় হয়েছি, আমাদের কাজের লোক বুড়ি করিমন যে এক একটা গল্প করতো, শুনে হাত-পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যেত। রাত দশটা ছিল আমাদের শোয়ার সময়, সে সময় আমরা বাড়ির ছোটরা সবাই মিলে একজন আরেকজনের গায়ে লাগালাগি করে শুতে যেতাম, আর গল্প বলত বুড়ি করিমন। ভূতের গল্প। 

“আমার দাদা ছিল উঁচা-লম্বা, ভাল স্বাস্থ্য, ফর্সা গায়ের রং। হের শেষরাইতে উঠলো পায়খানার চাপ। বদনা লইয়া বাইরে যাইতাছিল, তখন তো আর ঘরের লগে পায়খানা আছিল না। যাইতে হইত বাঁশবনের পাশ দিয়া। যাইতে গিয়া দেখল, মটমট কইরা হাড্ডি চিবানোর শব্দ হইতাছে। শিয়াল নয় কুকুর, তাই ভাবল দাদাজান। কিন্তু তারপর ঠাহর কইরা শুনল, মাংস চিবানোর চপচপ শব্দ। কাছে গিয়া দেখল, ও আল্লাহ, আমি আর কইতে পারুম না।” আমরা তাড়া দিই, বাকীটা বলতে হবে। সে আবার শুরু করে। “দেখল, কুচকুচা কালো এক মানুষ, বইসা আছে। হ্যার সামনে একটা মড়া, তার বুকটা চিইরা কলিজা আর হৃৎপিণ্ড বাইর কইরা কপকপ কইরা খাইতাছে। সে কি তৃপ্তি কইরা খাইতাছে, হুম হুম আওয়াজ বাইর হইতাছে। সেইগুলান খাওয়া শেষ কইরা চোখ দুইটা খুবলাইয়া তুইলা নিল, তারপর ভাতের লোকমার মতো মুখে পুইরা খাইতে শুরু করলো। দাদাজান আর সইতে না পাইরা দিল এক চিক্কার। সেইটা শুইনা ঐ মানুষটা তাকাইল, তার সে কি চাহনি। মুখ দিয়া রক্ত বাইর হইতাছে, আস্তে আস্তে উইঠা দাঁড়াইল। দাদাজান তো বদনা ফেইকা দিয়া ফালাইয়া দৌড়। তয় দশ পাও যাইতে পারলো না, আইসা ধইরা ফালাইল হ্যারে। যেইখানে হাত দিল, ফোস্কা পইড়া গেল, আগুনের মতন গরম। দাদাজান ভাবলেন, আইজ তাঁর মরণ। কিন্তু তখনই দিল ফজরের আজান। আর জিনিসটা বেমালুম গায়েব। তারপর থিকা আর দাদাজান রাইতে ঘরের বাইর হইতেন না, পেশাব-পায়খানা ঘরের মইদ্ধেই করতেন।” প্রতি রাতে আমাদের একটা গল্প শোনা ছিল বাঁধা। সারা বাড়িতে সবাই যেন ভয় পাওয়ার জন্য তৈরি থাকতো, বাচ্চাদের এবং বৌ-ঝিদের সবার হাতে নয় গলায় গরমপীর নাঙ্গুবাবার তাবিজ বাঁধা ছিল। রাতে বের হতে হলে উচ্চস্বরে গলা খাঁকারি দিয়ে, শব্দ করে তারপর বের হতে হতো। অমাবস্যা-পূর্ণিমায় বের হওয়া নিষেধ ছিল, কারণ সেসব রাতে “তেনারা” বের হন। কতজন কত কিছু দেখেছে, কিন্তু আমি কিছুই দেখি নি। আমি নাকি আমার নানার মতো সাহসী, লোকে বলত, এতটুকু বাচ্চার এত সাহস ভালো না। এই তো, আমার বড় চাচার কাছ থেকে সন্ধ্যায় হাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাজারের ব্যাগ থেকে মেছো ভূত মাছ নিয়ে গেল। আমার মা নাকি শাঁকচুন্নি বসে থাকতে দেখেছেন, হিজল গাছে বসে বসে পা দুলোচ্ছে, আর খোনা গলায় হাসছে। সেসব কতদিনের কথা, পিছে ফেলে এসেছি সেই গ্রাম, যেখানে “কবরখোঁড়া” কবর খুঁড়ত, আর মাটি চারদিক ছিটিয়ে ফেলত। সন্ধ্যা হলেই ভূত-পেত্নি আসর বসাত। এখন আমি থাকি শহরে, কথায় বলে, শহরে ভূত আসে না, তারা নাকি ভয় পায়! ঘুম আসছে না, একটা বই টেনে নিলাম, নাম “সুখের লাগিয়া”। একজন অখ্যাত লেখকের অখ্যাত বই। রোমান্স টাইপের হালকা উপন্যাস। ঘুম না এলেই আমি বই পড়ি, কয়েক পৃষ্ঠা পড়তে পড়তেই ঘুম এসে যায়। একটা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, বই পড়তে পড়তেই আওয়াজ পেলাম। কীসের আওয়াজ? বাথরুমে পানির ট্যাপ কি ছাড়া আছে, পানির ফোঁটা পড়ছে? কান লাগিয়ে শুনলাম। থপ, থপ। খুব মৃদু আওয়াজ। আবার হল। না, পানি পড়ার আওয়াজ নয়। তাহলে? কেউ কি হাঁটছে? কোথায়? বন্ধ জানালা খুলে দিলাম। বাইরে থেকে একটা ঠাণ্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগলো। না, বাইরে তো কেউ হাঁটছে না। তবে কি ছাদে? এতরাতে ছাদে কে হাঁটবে? আমি ভয় পাচ্ছি। পাচ্ছি তার প্রমাণ, আমার শরীর ঘামছে। গেঞ্জির হাতায় ঘাম মুছলাম। উঠে বসলাম। সাথে সাথেই শব্দটা থেমে গেল। ধূর, আমার কল্পনা। আবার শুয়ে পড়লাম। এবার সত্যিই ঘুম পেয়েছে। দু চোখ বুজলাম। সাথে সাথেই পেলাম আবার সেই শব্দটা। কেউ খুব হালকা পায়ে হাঁটছে। চোর-ছ্যাঁচোড় না তো? বলা তো যায় না, একটু দেখে নেয়া ভাল। আমি উঠলাম। শব্দ থেমে গেছে। জানালার পর্দা ভাল করে আটকে দিলাম, যাতে রাতবিরেতে নড়াচড়া দেখে ভয় না পাই। মানুষ তিলকে তাল বানায়, পর্দার নড়াচড়া দেখলে ভাবে ভূত। বাথরুমে গেলাম, পানির ট্যাপ ভালো করে আটকে দিলাম। পানির ট্যাপের শব্দও অনেকে ভুল শোনে। এবার ছাদে যেতে হবে। পিচ্ছিল সিঁড়ি কোনমতে টপকে টপকে পার হলাম। সামনে খোলা ছাদ, ছাদের মুখে এসে দাঁড়াতেই বাতাস এসে মুখে লাগলো। আকাশের দিকে তাকালাম, হঠাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে, আকাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, চাঁদ নেই। থেকে থেকে গর্জন করছে মেঘ। একবার বাজ পড়লো কাছাকাছি কোথাও, বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। আর সাথে সাথেই কারেন্ট চলে গিয়ে সব অন্ধকার। হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে এদিকওদিক আলো ফেললাম। যা ভেবেছি তাই। কেউ নেই। খামোকা ভয়কে প্রশ্রয় দিলে ভয়টা আরও পেয়ে বসবে। আমার নিরিবিলিতে থাকা শিকেয় উঠবে। নিজেকে বুঝিয়ে নিচে নেমে এলাম। ছাদে কোন দরজা নেই, ঝড়বৃষ্টিতে ঘরে পানি না পড়লেই হয়। নিচে নেমে এলাম। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার মাঝে শুধু টর্চের আলোর একটা রশ্মি। সেটা অন্ধকার দূর করতে পারছে না, বরং মনে হল, আরও গাঢ় করছে। নিচে নেমে এসে হাতড়ে হাতড়ে শুয়ে পড়লাম। টর্চটা নিভিয়ে দিতেই মনে হল, কবরের মধ্যে শুয়ে আছি। অন্ধকার কখনো এত গাঢ় হতে পারে, আগে জানতাম না। একটা কীসের গন্ধ পাচ্ছি, ঠিক চেনা গন্ধ নয়। দুর্গন্ধ। অনেকদিনের পচা ইঁদুর থেকে অনেকটা এমন গন্ধ আসে। কাল উঠেই খুঁজে বের করে সরিয়ে ফেলতে হবে, এখন আর শক্তি নেই। কিন্তু সত্যিই ইঁদুর তো? আমার অস্বস্তি যায় না। বাইরের বৃষ্টি তখন তুমুল আকার নিয়েছে। আমি কালিগোলা অন্ধকারে ঘুম দিলাম। ঘুমোনোর আগে মনে হল, হালকা পায়ে ঘরে কেউ হাঁটছে। একটা মানুষের অবয়ব, কিন্তু স্পষ্ট নয়। মানুষ অন্ধকারে দেখতে পায় না, কিন্তু জিনিসটা থেকে যেন খুব ম্লান একটা আলো বের হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল। তারপরই ভাবলাম, সারাদিনের কষ্টে মাথা গরম, ভুলভাল দেখছি। পরে বুঝতে পেরেছিলাম, ভুল দেখি নি। রাত কাটল কাটা কাটা দুঃস্বপ্ন দেখে। সকালে জেগে উঠে দেখি, মাথার এক পাশ দপদপ করছে, প্রচণ্ড ব্যথায় ঘাড় নাড়তে পারছি না। ঠাণ্ডা লাগলো নাকি? বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিলাম। বাইরে গিয়ে চা খেতে হবে, খুব গরম এক কাপ চা। ঠাণ্ডা মাথায় সব খতিয়ে দেখতে হবে। 

বাইরে এসে দাঁড়াতেই সকালের বাতাস এসে গায়ে লাগলো, আর আমার সব ভয় যেন কর্পূরের মত উবে গেল। সকালের বাতাসের এই একটা গুণ, রাতের সব গ্লানি মুছে দেয় এক নিমেষে। সামনে দিয়ে চলে গেছে সড়ক, গতরাতের বৃষ্টির ফলে ভেজা, খানাখন্দে ভরা সড়ক কাদায় প্যাচপ্যাচ করছে। ওপাশে একটা গাছ পড়ে আছে রাস্তার ওপর, কেউ এসে এখনো সরায় নি। হেঁটে হেঁটে চায়ের স্টলে পৌঁছলাম। ঘরে খাবার নেই, পাউরুটি, কলা আর এক কাপ চা দিয়ে নাস্তা সারলাম। গতকাল রাতে কী ঘটেছিল? সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছিলাম, তাই মাথা গরম হয়ে ছিল। ভুলভাল দেখা এই অবস্থায় খুবই স্বাভাবিক, ভুল কিছু শোনাও অস্বাভাবিক নয়। একা লোকালয় থেকে দূরে একটা বাসায় উঠেছি, অবচেতন মন আমাকে তাই শুনিয়েছে সন্দেহজনক শব্দ, নির্জন বাসায় প্রায়ই মানুষ শুনতে পায় নানারকম শব্দ, এমন তো হরহামেশাই শোনা যায়। হয়তো খুবই স্বাভাবিক একটা শব্দ, মস্তিষ্ক সেটাকে বানিয়ে ফেলেছে অন্য কিছু। তার ওপরে ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার, কারেন্ট ছিল না, ঝড়বৃষ্টির রাত, তাতেই সবকিছু নিজে নিজেই তৈরি হয়ে গেছে। আর গন্ধ? অনেকদিনের পুরনো বাসা, বোটকা একটা গন্ধ থাকা স্বাভাবিক। ভালোমতো আজ সারাবাড়ি ঝাড়পোছ করতে হবে, তাহলেই আর কোন সমস্যা থাকবে না। বাকি রইলো ঐ জিনিসটা, যেটা দেখেছিলাম। ওটা নেহায়েৎ চোখের ভুল ছাড়া আর কিছু বলে দাঁড় করানো যায় না। চা-টা শেষ করলাম, দাম মিটিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আবার ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম, অনেক কাজ পড়ে আছে। সামনের লনমতো জায়গাটা পেরিয়ে আবার যখন ঘরে ঢুকলাম, তখন মনে হতো, রাত্রে এই সাধারণ ঘরটা দেখেই এত ভয় পেয়েছি? কী আশ্চর্য! বালতি আর ঝাড়ু নিয়ে লেগে গেলাম, ঘরে এখনো আছে গন্ধটা। কোথায় পড়ে আছে মরা ইঁদুরটা? সারা বাড়ি ঝাঁট দিয়েও পেলাম না, হয়রান হয়ে গেলাম। তবে আমার ঘর দেখতে দেখতে পরিপাটি হয়ে উঠলো, দেখলে কে বলবে এটা একটা অগোছালো ব্যাচেলরের ঘর? তবে একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করলাম। ঘরের ঠিক মাঝ বরাবর, কয়েকবার বাড়ি দিতেই ফাঁপা আওয়াজ হল। নিচে কি আরও কিছু আছে? খুব ভালো করে লক্ষ করলাম, নজর করে না দেখলে বোঝাই যায় না, খুব কায়দা করে একটা দুই ফুট বাই দুই ফুট কাঠের তক্তা দিয়ে মেঝের সাথে মেশানো, রঙও নিখুঁত ভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্ঘাত নিচে একটা ঘর আছে, সেলারের মতো। এতক্ষণে শব্দের রহস্য ভেদ হল, বদ্ধ ঘরে বাতাস আটকে থেকে নানারকম আওয়াজ হয়। ঝড়বৃষ্টির দিনে তো কথাই নেই। ভাগ্যে ঘরে একটা শাবল ছিল, চাড় দিতেই উঠে এলো তক্তাটা। ওটা এক পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে উঁকি দিলাম। ভেতরে অন্ধকার। টর্চ এনে আলো ফেললাম, ভেতরে ময়লা আবর্জনা স্তূপ হয়ে আছে, কোনদিন পরিষ্কার করা হয়েছে বলে মনে হয় না। ভক করে এসে লাগলো পচা গন্ধ, ঠিক যেন সেপটিক ট্যাংকের মতো, বমি এসে যাবার মতো অবস্থা। তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলাম গর্তের মুখ। নেমে দেখলে হতো, কিন্তু ইচ্ছে করলো না। পরে দেখা যাবে। দুপুরে হোটেলে খেলাম। তখনো জানতাম না, রাতে কী অপেক্ষা করছে। ৪. রাত নেমেছে। খানিকটা রাত হলেই এলাকাটা বড় বেশি নির্জন হয়ে পড়ে। আমার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে, অস্বীকার করবো না। মাথা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। ঘুম দরকার। কারেন্ট নেই, মশা কামড়াচ্ছে, এই এলাকায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং, আর একবার কারেন্ট গেলে আর আসার নাম করেনা। মোমবাতি নিয়ে বাথরুমে গিয়ে মুখে-মাথায় পানি দিলাম। আয়নার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলাম। একটা অস্পষ্ট মুখ, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কি দাঁড়িয়ে আছে আমার পেছনে? অল্প আলোয় ভুল দেখছি না তো? ঠাহর করে দেখতে গেলাম, মিলিয়ে গেল মুখটা। আমার ঘাড়ের পশমগুলো দাঁড়িয়ে গেল, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল, কেন যেন মনে হল, অশুভ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। কোথায় যাব? আজ রাতটা কি হাসানের মেসে গিয়ে থাকবো? থাক, শুধু শুধু একজনের ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। বইটা টেনে নিলাম। ঘুম না আসা পর্যন্ত বই পড়ি। অল্প আলো, কিন্তু পড়া যাবে। উপন্যাসের এই পর্যায়ে নায়িকা শ্রাবণী ঘর ছেড়েছে, নায়ক অতুলের সাথে পালিয়ে যাবার জন্য। জানালা একটু ফাঁক করা আছে, বাতাস আসছে। হঠাৎ এক ঝলক জোরালো বাতাস এলো, যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল মোমবাতিটা। আহ, কি মুশকিল। হাতড়ে হাতড়ে জানালাটা বন্ধ করলাম, মোমবাতি জ্বালাতে হবে, কোথায় যেন দেশলাইটা? মেঝেতে পা ঠেকিয়েছি, এমন সময় কেঁপে উঠলো মেঝে। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, নিচে কিছু একটা হুটোপুটি করছে, ইঁদুর নয়, ইঁদুর এত জোরে শব্দ করে না। তাহলে কি? পালিয়ে যাওয়ার একটা তীব্র ইচ্ছা জাগল, কোনমতে নিজেকে ঠেকালাম। ধড়াস ধড়াস শব্দ করছে বুকের ভেতর, কণ্ঠনালী শুকিয়ে গেছে। কী করবো বুঝতে পারলাম না। একবার মনে হল, তক্তাটা তুলে ধরি, নিচে কি আছে দেখতেই হবে। পরক্ষণেই মনে হল, না না, সেটা পারবো না। নিচে আছে ভয়ংকর কিছু। কোন পিশাচ যেন এখানে আটকা পড়ে ছিল এতদিন, আমি আসাতেই সেটা আজ মুক্ত হয়ে গেছে। নিজের ওপর তখন আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। ভয়ে ভয়েই নিয়ে এলাম শাবলটা। শক্ত করে ধরে চাড় দিলাম। সকালের মতোই উঠে এলো তক্তাটা। নিচে টর্চের আলো ফেললাম। বাইরে ঝড় শুরু হয়েছে, গতকালের মতোই তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়লো, কেঁপে উঠলাম আমি। গর্তের ভেতরটা চিরে দিল আলোর রশ্মি, কি যেন একটা বাঁ দিক থেকে ডান দিকে সরে গেল, ভালো করে বোঝার আগেই। আমার তখন রোখ চেপে গেছে, কী আছে দেখতেই হবে। বেঁচে থাকার আদিম প্রবৃত্তি বলছে, নেমো না, সাংঘাতিক বিপদ ঘটবে। আমি সেটা উপেক্ষা করেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিচে নেমে গেলাম। হাতের তালু ঘেমে গেছে, হাত থেকে পিছলে যেতে চাইছে শাবলটা। টর্চটা দাঁতে কামড়ে ধরে নিচে নেমে হাতের ধুলো ঝাড়লাম, শাবলটা আঁকড়ে ধরলাম। আশেপাশে চোখ বুলোলাম। কী আছে? একটা ভাঙা টেবিল ছাড়া সারা ঘরে আর কিছু … … হ্যাঁ, ঐ তো , তালগোল পাকানো কী একটা যেন ঘরের কোণায় পড়ে আছে। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম। জিনিসটা কী, দেখে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। একজন পুরুষের লাশ, থুতনির ঠিক নিচ দিয়ে একটা ছোরা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। চোখের মণিতে স্পষ্ট ভয়ের ছায়া, আর সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার, বাঁ দিকের গাল থেকে কেউ যেন কামড়ে মাংস তুলে নিয়েছে, সেখান দিয়ে মুখের ভেতরটা দেখা যাচ্ছে, সেখানে পোকা কিলবিল করছে। আমি সামনাসামনি কখনো এমন বীভৎস লাশ দেখিনি, ছোট একটা চিৎকার দিয়ে উঠলাম, কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। হাতে ঠেকল ঘরের দেয়াল, চটচটে লাগতেই চোখের সামনে ধরলাম। খয়েরি-লালে মেশানো বিচিত্র এক তরল। নাকের কাছে নিতেই গা গুলিয়ে উঠলো। রক্ত আর পুঁজ একসাথে করে দিলে এমন হওয়ার কথা, গন্ধটা বাসী নাড়িভুঁড়ির মতো। আমার সারা গা তখন গুলোচ্ছে, কিন্তু লাশটা এখানে এলো কী করে? আমি বেরিয়ে যাবো বলে ঠিক করলাম। এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে সোজা আমার মালপত্র নিয়ে চলে যাবো। এখানে আর নয়। তখনই মাথার উপরে দড়াম করে একটা শব্দ হল। না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম, আমার বেরোবার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। মরিয়া হয়ে উঠলাম আমি। অশুভ কিছু একটা আছে এই ঘরে, আমাকে বের হতেই হবে। জোরে ধাক্কা দিলাম, ভারী তক্তা নড়ল না। প্রমাদ গুনলাম আমি। এখানে ঢুকেছি, কেউ জানে না। হাসান আসতে পারে, কিন্তু ততদিনে দম আটকে মরে যাবো, আর নইলে ভূতের হাতে মরবো। পাগলের মতো ধাক্কাতে থাকি আমি। ঘরে তখন আমার চারপাশ ঘিরে তখন সাদা ধোঁয়ার মতো কিছু একটা পাক খাচ্ছে, আর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমি দেখি, সেটা একটা কিছুর আকার নিচ্ছে। ঘরের এক কোণে জড়ো হল সেগুলো, আর ধীরে ধীরে একটা অবয়বে রূপ নিতে লাগলো। টলতে টলতে সেটা এগিয়ে আসতে লাগলো আমার দিকে। হ্যাঁ, একটা মানুষের অবয়ব, তবে মানুষ নয়, মানুষ এত বীভৎস দেখতে হয় না। মুখটা যেন কেউ অ্যাসিডে ঝলসে দিয়েছে, সারা মুখ ভর্তি দগদগে ঘা। একবার মুখ হাঁ করলো, আমি শিউরে উঠলাম লাল জিহবা দেখে, মুখ থেকে দুর্গন্ধযুক্ত লালা গড়াচ্ছে জিনিসটার। আমি সর্বশক্তি দিয়ে তক্তাটা সরিয়ে ফেলি, শরীরটা ওপরে টেনে ওঠাই, কিন্তু পুরো শরীর বের করার আগেই পায়ে একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করি, জিনিসটা আমার পায়ে কামড় বসিয়ে দিয়েছে, হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেছে, তারপরেও দেখতে পেলাম, বাঁকানো শ্বদন্ত ঢুকে গেছে পায়ের মাংসে। আমি শাবলটা দিয়ে কুৎসিত জীবটার মাথায় আঘাত করি, আমাকে ছেড়ে দিয়ে জিনিসটা পিছিয়ে যায় কয়েক পা। পা থেকে রক্ত পড়ছে আমার, কিন্তু অনুভূতি হয় না, আমি তক্তাটা দিয়ে গর্তটার মুখ বন্ধ করে দিই। পালাতে হবে, এখনই। ভেতর থেকে তখন ভেসে আসছে জান্তব চিৎকার, যেন কাউকে নির্মমভাবে আঘাত করা হচ্ছে, কেউ যেন বিলাপ করছে, গোঙাচ্ছে, সব মিলিয়ে অমানুষিক একটা নারকীয়তায় রূপ নিয়েছে বাড়িটার পরিবেশ। বাইরে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি তখন, আমি দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াচ্ছি। ভয়ে হৃৎপিণ্ড গলায় উঠে এসেছে, ধক ধক করছে, এই বুঝি জিনিসটা আমাকে ধরে ফেললো, আমি জনশূন্য রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছি। পেছনে তাকাতে সাহস হয় না, উহ, জায়গাটা এত অন্ধকার কেন? হোঁচট খেতে খেতে আমি শহরের দিকে দৌড়াই। সামনেই বাজার, ঐ তো চায়ের স্টল, কিন্তু এত রাতে সব বন্ধ। কোথায় যাবো আমি? সব দরজা যেন আমার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে, আমি হাসানের বাড়ির দিকে দৌড়াতে থাকি।

পুনশ্চঃ

রিয়াজ অবশেষে হাসানের বাসায় পৌঁছাতে পেরেছিল। হাসান যখন বাড়ির দরজায় তাকে আবিষ্কার করে, তখন তার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে, প্রচণ্ড পরিশ্রমে ধপ করে বসে পড়ে সে, তারপরই জ্ঞান হারায়। হাসান পুলিশে খবর দিয়েছিল, পুলিশ তো শুনে প্রথমে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল (নাকি ভয় পেয়েছিল?) । শেষে ওপর মহলের ভয় দেখাতে কাজ হল। কয়েকজনের একটা দল পাঠায় তারা, মৃতদেহ উদ্ধার করে। এই লাশ কোত্থেকে এলো, সুরাহা করতে পারে নি তারা, লাশের পরিচয়ও উদঘাটন করতে পারে নি। অশরীরী কিছু পায় নি তারা, তবে একটা অস্বস্তিকর গন্ধ পেয়েছে। কে জানে, সবই হয়তো রিয়াজের ভুল। থানায় অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়েছে। ভয়াবহ অভিজ্ঞতা রিয়াজকে এলোমেলো করে দিয়েছিল, সাইকোথেরাপি নিতে এসেছিল আমার কাছে। কয়েক মাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয় সে। এখন সে ভাল আছে। “সুখের লাগিয়া” উপন্যাসের সমাপ্তি আমাকে বলেছে। শ্রাবণীর সাথে অতুলের বিয়ে হয়ে গেছে। রিয়াজের পায়ে এখনো আছে কামড়ের দাগটা। বাড়িওয়ালা খান মজলিশ সাহেব বাড়িটা ভেঙে ফেলার লোক লাগিয়েছিলেন, কিন্তু সে রাতের খবর কেমন করে যেন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, ভয়ে শ্রমিকেরা কেউ কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। এখনো ঝড়বৃষ্টির রাতে নাকি আলো জ্বলে ওঠে বাড়িটাতে, ভেসে আসে অমানুষিক চিৎকার।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.