সোনাগাছির 'মা', মাতৃ দিবসে অন্ধকারে যে জননীরা

বিক্রম: মুন্নি আদপে বাংলাদেশের মেয়ে। মুন্নি যখন ১০ বছরের তখনই এক রঙিন জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে আর বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কলকাতার সোনাগাছিতে তাকে পাচার করে দেয় এক যুবক। তার পর থেকে সোনাগাছিতেই কেটে গিয়েছে তার পাঁচ বছর। বাবা-মার কথা এখন সে ভুলে গিয়েছে প্রায়। আজ তার মহিলা দালালটিকেই ‘মা’ বলে ডাকে সে। তিনি ভালবাসেন তাঁকে। প্রতি বছর দুর্গাপুজোয় কিনে দেন শাড়ি। এখন মু্ন্নির বয়স ১৬। কিন্তু ‘মা’-এর পরামর্শে ‘খদ্দের’দের কাছে সে নিজের বয়স বলে ২০ বছর।
সোনাগাছিতে আসার পরে একেবারে প্রথম দিনগুলির অভিজ্ঞতা এখনও ভুলতে পারে না মু্ন্নি। সোনাগাছিতে যে ‘মাসি’র ঘরে তাকে বাংলাদেশ থেকে এনে তোলে তার সেই যুবক সঙ্গীটি, সেই মাসি প্রথম কয়েকদিনেই ভাল ভালে পোশাক-আশাক আর খাবার-দাবারের বিনিময়ে মন জয় করে নিয়েছিলেন মুন্নির। মুন্নি বোঝেওনি কী উদ্দেশ্যে তাকে আনা হয়েছে এখানে। কিন্তু সোনাগাছিতে আসার তৃতীয় দিনে মুন্নিকে আরও জনা কুড়ি মেয়ের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল রাস্তায়। প্রথমটায় মুন্নি ভেবেছিল নতু‌ন কোনও বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করা হচ্ছে বুঝি তাদের। কিন্তু একটু পরেই ভুল ভাঙে তার, সে বুঝতে পারে ‘খদ্দের’ ধরার জন্য দাঁড় করানো হয়েছে তাকে। বোঝা মাত্রই পালানোর চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু মাসির লোকজন তাকে ধরে ফেলে। একটা অন্ধকার ঘরে বেশ কয়েকদিন বন্দি করে রাখা হয় তাকে। একটা মোটা লাঠি দিয়ে মারধোরও করা হয়। তবে এখনও মনে আছে মুন্নির, কিছুতেই তার মুখ, বুক বা উরুতে কোনওরকম আঘাত করা হত না। ওইসব জায়গায় আঘাতের দাগ পড়লে শরীরের বাজারে ‘দাম’ পড়ে যাবে যে তার।
sex-worker-and-child12-354525f54e09b2d354d0c52e822168c617e7603a
ওরা মায়ের পরিচয়ে বাঁচে
সোনাগাছির সব মেয়েই যে মুন্নির মতো কোনও দালালের হয়ে কাজ করে, তা নয়। অনেকে এখানে ঘর ভাড়া নিয়ে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করে তাদের বাণিজ্য। মুন্নি জানাচ্ছে, বছর দু‌য়েক আগেও প্রতি ক্রেতার কাছ থেকে ঘন্টা প্রতি হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেত সে। তেমন তেমন মেয়েরা পেত ঘন্টা প্রতি ছয়-সাড়ে ছয় হাজার টাকা। কিন্তু এই দু’বছরে পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। ব্যবসা আর এখন আগের মতো চলে না। তাই মাসির নির্দেশে সব মেয়েই এখন তাদের ক্রেতাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে নেয়। রোজগারের ৫০ শতাংশ দিতে হয় মাসিকে। কারা সেই ক্রেতারা যাঁরা আসেন মুন্নিদের কাছে? মুন্নি জানাচ্ছে, বেশিরভাগই আসে কলেজছাত্র। তবে আইনজীবী, রেস্তোরাঁ মালিক, ট্যাক্সি চালক থেকে শুরু করে ছাপোষা মধ্যবিত্ত, এমনকী কিছু বিদেশি পর্যন্ত আসেন তাদের কাছে।

মুন্নি আরও একটা ঘটনা শোনায়। ওদের দলেরই একটা মেয়ে সম্প্রতি মা হয়ে যায়। কিন্তু সন্তানের বাবা কে? সেটা তো আর জানা নেই। এমন অবস্থায় মাসি বলে বাচ্চাটা নষ্ট করে দিতে। কিন্তু ওদের দলের সেই মেয়ে টুম্পা রাজি হয় না। এদিকে মাসি স্পষ্ট বক্তব্য বাচ্চা হয়ে গেলে এই বাজারে তার  দাম কমে যাবে। পেট, স্তন যাবে ঝুলে। খদ্দের পাবে না সে। কিন্তু টুম্পা কিছুতেই একটা প্রাণকে মারতে চায়নি। তাই মাসি এক রাতে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। টুম্পার তখন ৭ মাস চলছে। বড় পেট নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে সে। মুন্নি সেদিন নিজের জমানো প্রায় ২০০০ টাকা টুম্পাকে দিয়েছিল। তারপর টুম্পা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এখনও মুন্নি খোঁজে টুম্পাকে। কিন্তু সোনাগাছির কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি। এমন অনেক মা হারিয়ে গিয়েছে সোনাগাছির অন্ধকার গলিগুলো থেকে। 
Blogger দ্বারা পরিচালিত.