মগের মুলুক, কারা এই মগ?
Odd বাংলা ডেস্ক: রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস। দক্ষিণে ‘মগ’ ও উত্তরে ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে ‘মগ’দের। একসময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়।
১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের আরাকান স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর চরম বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে যায় পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। খুন-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। জোর করে সহায়-সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। বর্তমান মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা গ্রহণেরও সুযোগ নেই। রোহিঙ্গা জনসংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য বিয়ে ও সন্তান গ্রহণের মতো বিষয়েও তাদের ওপর একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘কালা’ নামে পরিচিত। বাঙালিদেরও তারা ‘কালা’ বলে। সেখানে ভারতীয়রাও একইভাবে পরিচিতি। এই ‘কালা’ শব্দটি সেখানে সীমাহীন ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একদিকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, অন্যদিকে উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের তাণ্ডব! এমন বাস্তবতায় বহু বছর ধরেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দেশান্তরী হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। একারণে প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় সবচেয়ে বড় ধকলটি যাচ্ছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে।
ইতিহাস কি বলে?-
১৬২০ সালে ঢাকায় ব্যাপক হামলা করেছিলো মগেরা। সেসময় বাংলার সুবাদার ইব্রাহীম খান তাদের প্রতিহত করেছিলেন।
১৬২৫ সালে মগদের রাজা আরাকান রাজ শ্রী সুধর্ম মোঘল রাজধানী ঢাকায় আক্রমন করে। তার সাথে পরাজিত হয়ে সুবাদার আমজাদ খান পালিয়ে যায়। তিন দিন ঢাকায় অবস্থান করে মগেরা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আরাকানে ফিরে যায়।
ঢাকার মগবাজার নামটি মগদের আগ্রাষণের একটি জ্বলন্ত স্বাক্ষী!
ইংরেজরা চলে যাবার সময়, আরাকান রাজ্য বা মগরাজ্যকে বার্মার সাথে একীভূত করে দিয়ে যায়।
বর্তমান ইন্ডিয়ায় যেমন, অতীতের অনেক স্বাধীন রাজ্যের ভূমি রয়েছে, ঠিক বর্তমান বার্মাতেও অতীতের অনেক স্বাধীন রাজ্যের ভূমি রয়েছে।
‘মগের মুল্লুক’ শব্দটা মগদের অভাবনীয় অত্যাচারের স্বাক্ষী হয়ে, বাঙলা ভাষায় আজও যেকোন ভয়াবহ অরাজকতার নির্দেশক শব্দ হয়ে, বেঁচে আছে!
প্রায় আড়াইশত বৎসর বাংলায় মগদের অত্যাচার স্থায়ী হয়েছিল!
মুর্শিদকুলি খান সুবাদার হয়ে মগদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অভিযান চালালে অত্যাচার কিছুটা স্তিমিত হয়।
পলাশীর যুদ্ধের পরেও কলকাতাবাসী মগদের অত্যাচারের আতংকে দিন কাটাতেন।
মগরা যেসব এলাকায় হামলা চালাত সেসব এলাকার সাধারন ঘটনা গুলো ছিলো- ব্যাপক মাত্রার ধর্ষণ, যুবকদের বন্দী করে ধরে নিয়ে যাওয়া, ধ্বংসযজ্ঞের লীলাক্ষেত্র, হরিলুট ইত্যাদি!
মগরা গোলাম হিসেবে যেসব যুবকদের ধরে নিয়ে যেত তাদের পা ও হাতের তালু ছিদ্র করে বেঁতে ঢুকিয়ে বাঁধা হত!
এভাবে গাদা করে সেইসব হতভাগ্য বাঙালী যুবকদের নৌকার পাটাতনের নিচে ফেলে রাখা হত। ফলে তারা কোনমতেই পালিয়ে যেতে পারত না।
মুরগিকে যেভাবে চাল ছিটিয়ে খেতে দেয়া হয় ঠিক সেভাবেই বন্দী যুবকদেরকে খাদ্য হিসেবে তাদের দিকে চাল নিক্ষেপ করা হত।
মগ জলদস্যুরা পর্তূগীজ জলদস্যু (ফিরিঙ্গি) দের সাথে হাত মিলিয়ে বাংলার উপকুলীয় এলাকাকে বিশাল একটা সময় ব্যাপী জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছিল! তাদের অত্যাচার, ধর্ষণ, অন্যায়ের অতিসহ্যে ঐসব এলাকা মানব শূন্য হয়ে পড়ে।এসব এলাকায় জঙ্গলে ভরে গিয়েছিলো, সন্ধ্যায় সেসব অঞ্চলের নদীর দুই ধারে সন্ধ্যাবাতি জ্বালাবার কোন লোক বিদ্যমান ছিলোনা।
প্রভাবশালী মগ নেতা মংগত রায় ১৬৬০ সালে ঢাকার আব্দুল্লাহ পূরে মোগল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে মারা যায়।
‘পূর্ববঙ্গ গীতিকায়’ মগদের নৃশংস বিভীষিকার বর্ণনা সমূহ এসেছে।
এতসব বিভীষিকাময় বর্ণনার পরেও ইতিহাসে মগদের অতুলনীয় অত্যাচারের যত সামান্য ঘটনাই এসেছে বলে ইতিহাস বিশ্লেষকগণ উল্লেখ করেন। মগ জাতীর ভয়াবহ নির্যাতন চর্চার কিছুটা রোহিংগা নির্যাতন থেকে উপলব্ধি করা যায়।





Post a Comment