রক্তমাখা অভিশপ্ত কোট, ৪ কোটিরও বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ

Odd বাংলা ডেস্ক: রক্তমাখা একটি সামরিক পোশাক এটি। কোটটি শুধু যে রক্তমাখা থাকার কারণে বিশেষ, তা নয়। এই রক্তের বদলায় প্রাণ গিয়েছিল ৪ কোটি মানুষের। কোটটি ছিল আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের। ১৯১৪ সালের জুন মাসের ২৮ তারিখ স্ত্রী সোফিকে নিয়ে ঘুরতে যান বসনিয়ায়। ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি দেশ। সারাজেভ হচ্ছে দেশটির রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। 

সারাজেভ বসনিয়ার রাজধানী হলেও সে সময় এই অঞ্চলটি এই সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। সেই শহরটিতে যাওয়ার পরে তারা দুজন যখন একটি সড়ক দিয়ে গাড়ি করে যাচ্ছিলেন তখন পাশ থেকে একজন গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে মারে। বোমাটি গাড়ির পেছনে দিকে আঘাত করে এবং ফেটে যায়। গাড়ির পেছনের দিকে থাকা তাদের গার্ড দিতে যে সৈন্যটি ছিল সে গুরুতর আঘাত পায়। তবে আর্চডিউক এবং তার স্ত্রী অক্ষত থাকেন। তখনকার মতো তাদেরকে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আহত সৈন্যটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেদিন এই ঘটনার পরে আর্চডিউক তার সঙ্গে আসা লোকজনদের বলেন, তিনি তার পরিকল্পনাতে পরিবর্তন আনতে চান। প্রথমে তিনি হাসপাতালে যেতে চান তার আহত সৈন্যকে দেখতে। তিনি এবং তার স্ত্রী আবারও গাড়িতে করেই রওনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তাদের পরিকল্পনায় যে খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে তা জানানো হয়নি। তাই মূল যে পরিকল্পনা ছিল সে অনুযায়ীই প্রথমে সব চলছিল। আর্চডিউক এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে মোট চারটি গাড়ি রওনা দেয়। উৎসুক জনগণের ভিড়ের মধ্যে গাড়িগুলো খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছিল। ফ্রাঞ্জ জোসেফ নামক একটি সড়কের প্রবেশপথে এসে গাড়িটি আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী পথের দিকে মোড় নেয় এবং এগোতে থাকে। সেই গাড়ির ভেতরে রাজ্যের অতিথিদের দিকে মুখ করে বসে ছিলেন আর্চডিউক নিজেই।

গাড়ি সেই পথে এগিয়ে যেতে থাকলে তিনি গাড়ির চালক। যাকে বলা হত শৌফার। তাকে ফার্দিনান্দ বলেন যে, সে ভুল পথে যাচ্ছে। আগে হাসপাতালে যেতে হবে। তখন শৌফার গাড়িটির গতি ধীর করে রাস্তার ডান পাশের ফুটপাথের কাছাকাছি চলে আসে। ঠিক তখনই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক মাত্র তিন গজ দূর থেকে দুটি গুলি করে। গাড়িতে থাকা আর্চডিউকের গ্রীবার ধমনীতে গিয়ে একটি গুলি বিদ্ধ হয়ে ঢুকে যায় এবং ডিউক-পত্নীর উদরের ভেতর আরেকটি গুলি বিদ্ধ হয়। সেখানেই তারা দুজন মারা যান।

নিশ্চয় বুঝে গেছেন কার কথা হচ্ছিল এতক্ষণ! আর্চডিউক ছিলেন তৎকালীন সময়ের অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী। এই সাম্রাজ্যের মুকুট পরবর্তীতে তারই পরার কথা। এই হত্যাকাণ্ডের প্রায় ছয় সপ্তাহ পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। হত্যাকাণ্ডই সূচনা ঘটায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের, যে যুদ্ধকে বলা হয় 'দ্য ওয়ার টু এন্ড অল ওয়ার্স'। এই এক রক্তমাখা কোটই পরবর্তীতে ৪ কোটিরও অধিক মানুষের হতাহতের কারণ হয়েছিল। সারায়েভোতে আর্চডিউকের সফরের দিনে সবাই যে খুশি ছিল তা নয়। বসনিয়ার অনেক জাতীয়তাবাদী তরুণই এই ব্যাপারটা নিয়ে ক্ষিপ্ত যে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য তাদের দেশকে দখল করে নিয়েছে।

অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ানরা সেখানে ছিল ১৮৭৮ সাল থেকে। এই সময়টুকুর মধ্যে তারা পুরনোর ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটায় নি। কৃষকরা তখনো সামন্তবাদী ভূস্বামীদের দাসের মতো। এটা ছিল একটা পুরোনো ঔপনিবেশিকা শোষণের পরিস্থিতি। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ানদের আগ্রহ ছিল একটা জিনিসের প্রতিই। সেটা হলো কাঠ। বসনিয়ার উপত্যকাগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে কাঠ পাওয়া যায়। সেই কাঠ তারা নিয়ে যেতো- তবে তার বিনিময়ে স্থানীয় অধিবাসীরা কিছুই পেতো না।

সেসময় ইউরোপের কেন্দ্রীয় শক্তিধর দেশ ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং ইতালি। আঁতাত বা বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়া। তিনটি করে শক্তিধর দেশগুলো দুটি গ্রুপে বিভক্ত ছিল। দুই গ্রুপের মধ্যে একে অন্যের সঙ্গে শত্রুতা ছিল। নিজেদের শক্তি দেখানোর জন্য তারা নিজেদের দেশে অস্ত্র বৃদ্ধি করে যাচ্ছিল।

এই হত্যাকাণ্ডটি যে ঘটিয়েছিল তাও প্রকাশ পায়। কেননা হত্যাকারী সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পরে যায় প্রহরীদের কাছে। সেই আততায়ীর নাম গেব্রিল প্রিন্সিপ, ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ। শুনানির সময় সে বলে, সে দুবার ফার্দিনান্দকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। গুলি করার পর সে নিজে আত্মহত্যা করার জন্য হাত তুললে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে ধরে ফেলে এবং মারধর করে। সেখান থেকে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। প্রিন্সিপ শেষে এটাও বলে যে, সে কোনো আসামী নয় এবং সে কোনো ভুল করেনি। সে একজন খারাপ মানুষকে মেরে ফেলেছে এবং তার কাছে মনে হয়েছে এটাই সঠিক। 

এরপরে জেলে নিয়ে যাওয়ার পরে সে অনেকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সফল হয়নি। আবার তার বয়সের কথা চিন্তা করে তাকে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া যাচ্ছিলো না। পরবর্তীতে অপুষ্টিতে ভুগে এবং যক্ষ্মাতে আক্রান্ত হয়ে সে মারা যায়। সে কোনো দলের লোক ছিল না। সাধারণ জনগণের একজন। তবে তারপরও এই হত্যাকাণ্ডটির প্রতিশোধ হিসেবে সৃষ্টি হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের।  

বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে রাজনৈতিক এবং সামাজিক বড় যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে তার অন্যতম কারণ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯০০ সাল এবং তার আশেপাশের সময়ে পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো ছিলো ইউরোপের অধীনে। বিজ্ঞানের দিক থেকে উন্নতি তো বটেই, শিল্প-কারখানা এবং ধন-সম্পদের দিক দিয়েও ইউরোপিয়ানদের ধারে-কাছে কোনো দেশ ছিলো না। সেসময় এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলো দেশ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশ ছিল। সমুদ্রে বাণিজ্যের যে জাহাজ চলতো, তার প্রায় সবগুলোই ছিল ইউরোপীয়দের অধীনে।

তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপসহ তাবড় তাবড় দেশগুলোর অর্থনৈতিক কাঠামো একেবারেই ভেঙে পরে। মারা যায় ৪ কোটির বেশি মানুষ। এই যুদ্ধ ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই ইউরোপে শুরু হয় এবং ১১ নভেম্বর ১৯১৮ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ৬ কোটি ইউরোপীয়সহ আরো ৭ কোটি সামরিক বাহিনীর সদস্য ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম এই যুদ্ধে একত্রিত হয়। এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাতের একটি। এই মহাযুদ্ধে প্রায় ১৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যক্ষ ও ১৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরোক্ষ খরচ হয়। যা ইতিপূর্বে ঘটিত যেকোনো যুদ্ধব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। 

এই যুদ্ধে চারটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। রোমান সাম্রাজ্য বা রুশ সাম্রাজ্য ১৯১৭ সালে, জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য ১৯১৮ সালে এবং উসমানীয় সাম্রাজ্য ১৯২২ সালে। অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা অধিকাংশ আরব এলাকা ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। ১৯১৭ সালে বলশেভিকরা রাশিয়ার এবং ১৯২২ সালে ফ্যাসিবাদীরা ইতালির ক্ষমতায় আরোহণ করে। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.