বিশ্বের সবচেয়ে দামী কাপড়, ব্যবহার করতেন শুধু ইনকা রাজারা

Odd বাংলা ডেস্ক: ইনকা সাম্রাজ্য নেটিভ আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সাম্রাজ্য ছিল। ইনকা শাসকরা ছিলেন অভিজাত রাজকীয় বংশের। সম্রাটকে বলা হত ইনকা। পরে অবশ্য সভ্যতার নামই হয়ে যায় ইনকা। সম্রাটের অন্য নাম সাপা ইনকা। সাম্রাজ্য পরিচালনতা করত রাজকীয় পরামর্শসভা।

পুরোহিত প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সেনাপতির সমন্বয়েই গড়ে উঠত রাজকীয় পরামর্শসভা। এরা সর্ম্পকে আত্মীয়। সম্রাটগন বিয়ে করতেন আপন বোনকে। পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করতেন। সাধারণত বড় ছেলেই সম্রাট হত। ইনকা অভিজাতদেরও কাউন্সিল ছিল। তারা সাম্রাজ্য পরিচালনায় সাহায্য করত। 

সমস্যা হলো প্রধান পুরোহিত সম্রাটের আত্মীয় ছিলেন। সেনাপতিও বন্ধু কি আত্মীয়ই হত সম্রাটের। ইনকা যোদ্ধারা অন্য নগর আক্রমন করে জয় করলেও স্থানীয় শাসনকর্তাকে হত্যা করত না যদি সে শাসনকর্তা ইনকা আইন মেনে চলত, বিদ্রোহ করত না, কর দিত আর শস্য ভান্ডার মজুদ রাখত। ইনকাদের কর ব্যবস্থা ছিল কঠোর। নারীদের নির্দিস্ট পরিমাণে কাপড় বুনতে হত। পুরুষেরা কাজ করত সৈন্যবিভাগে কি খনিতে। জনগণও কর দিতে হত। হাতে পয়সা না থাকলে রাষ্ট্রীয় কাজ করে শোধ করে দিত। কিংবা সুতা পোশাক তৈরি করে বিক্রি করে কর দিত। জনগণকে শস্যের একাংশ রাখতে হত সংরক্ষণের জন্য। খাদ্যশস্য মজুদের কলাকৌশল রপ্ত করেছিল বলেই ইনকা সভ্যতা নাকি অত উন্নত স্তরে পৌঁছেছিল-ঐতিহাসিকদের এই মত। সাম্রাজ্যজুড়ে ছিল স্টোরহাউজ। ৩ থেকে ৭ সাত বছরের খাদ্যশষ্য মজুত থাকত সেখানে। মাংসও শুকিয়ে নোনা করে রাখত। 

চাষবাস হত উপত্যকায় আর পাহাড়ের ঢালে। ইনকাদের প্রধান খাদ্যই ছিল আলু ও ভূট্টা। মানবসভ্যতায় আলু কিন্তু ইনকাদের অবদান। আলু আর ভুট্টা ছাড়া তাদের খাবারের তালিকায় ছিল ওল। নীল শ্যওলাও নাকি খেত তারা। তাদের চাষাবাদের মধ্যে ছিল মরিচ। মাংসের মধ্যে খেত গিনিপিগ ও লামার মাংস। সামুদ্রিক মাছও তাদের প্রিয় খাবার। সাম্রাজ্যের পশ্চিমে প্রশান্ত সাগর। আর বিখ্যাত হ্রদ টিটিকাকা। ভূট্টা পিষে এক ধরনের পানীয় তৈরি করে খেত ইনকারা। পানীয়ের নাম চিচা। পেরুতে এটি এখনো জনপ্রিয়। 

ইনকা সভ্যতার মানুষ পোশাকের ব্যাপারেও ছিল একটু খুঁতখুঁতে। পোশাক শুধু আব্রু রক্ষার কাজই করে না। রুচি এবং সামাজিক অবস্থানও বোঝায়। পোশাক নিয়ে বিশ্বের নানা জায়গায় বিভিন্নরকম রীতিনীতি প্রচলিত আছে। বেশ কিছু জায়গার মানুষেরা কোনো একটি বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করেন, কেউ আবার পোশাক পরিধান করার ক্ষেত্রে তার উৎস সন্ধান করে থাকে। অর্থাৎ অনেক মানুষই উল জাতীয় পোশাক অর্থাৎ পশমের পোশাক পরেন না, কারণ সেগুলো প্রাণীদের দেহ থেকে সংগ্রহ করা হয়। তাদের মতে প্রাণীর দেহ থেকে পশম সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে অবলা জীবদের ওপর নির্যাতন করা হয়।

পোশাকের গুণগত মান এবং দামের ওপর ভিত্তি করে সমাজে যথেষ্ট শ্রেণি বিভাজন দেখা যায়। কিন্তু মধ্য যুগে দক্ষিণ আমেরিকার একাংশে এক অদ্ভুত নিয়ম প্রচলিত ছিল। এক বিশেষ ধরনের পশমে তৈরি পোশাক কেবলমাত্র রাজপরিবারের মানুষজনই ব্যবহার করতে পারত, সাধারণ প্রজাদের জীবিত অবস্থায় ওই পোশাক ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। তবে মৃত্যুর পর সাধারণ মানুষের সঙ্গে ওই পশমের পোশাকের একটা ছোট্ট টুকরো দিয়ে দেয়া হতো। গোটা বিষয়টি খুব অদ্ভুত হলেও এটাই ঘটত ইনকা সাম্রাজ্যে। কারণ ইনকারা এই বিশেষ পশমের পোশাকটিকে ‘ঈশ্বরের কাপড়’ বলে মনে করত। 

ইনকাদের কাছে এতোটা মূল্যবান ছিল যে পশম সেটি আসত ভিকুনা নামে এক বিশেষ ধরনের প্রাণী থেকে। এটি দেখতে পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকায়। চিলি, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরুতেও এই প্রাণীর দেখা মেলে। এটি অনেকটা ছাগল ও ভেড়ার মিলিত রূপের মতো দেখতে। তবে ছাগল বা ভেড়ার থেকে ভিকুনা অনেকখানি আলাদা। এদের‌ গায়ের পশম থেকেই আজও পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান পোশাকগুলো প্রস্তুত হয়ে থাকে। কাশ্মিরী পশমের তৈরি শালের কথা জানেন নিশ্চয়? এটি বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান কাপড়। সবার সাধ্যের নাগালে নেই এই কাপড়। তবে ভিকুনার পশম দিয়ে তৈরি পোশাক কাশ্মীরি শালের থেকেও বহু মূল্যবান। 

ইনকা আমলে ভিকুনাকে ঈশ্বরের দূত মনে করা হত। তাই এই প্রাণীটিকে হত্যা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল সেসময়। কোনো ব্যক্তি যদি ভিকুনা হত্যা করত তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান ছিল। তবে কেবলমাত্র রাজ পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন মতো পশম সংগ্রহ করা হত।  

১৫৩২-৩৫ সালের মধ্যে স্প্যানিশরা যখন ইনকা রাজাকে পরাজিত করে ওই অঞ্চলের শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়, তখন থেকে এই বহুমূল্য প্রাণীটির বিপত্তির শুরু। নির্বিচারে হত্যা করে ভিকুনার মাংস খেত এবং গায়ের চামড়া অধিক মূল্যে ইউরোপের বাজারে রফতানি করত স্প্যানিশরা। প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে এর ফলে একসময় বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীতে পরিণত হয় এরা। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে এদের সংখ্যা মাত্র ৫ হাজারে এসে দাঁড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই এই বহুমূল্য প্রাণীটিকে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর সংরক্ষণ করার জন্য কঠোর বিধি জারি করলে আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। এই মুহূর্তে বিলুপ্তপ্রায় শ্রেণীর তকমা থেকে বেরিয়ে এসেছে ভিকুনা। 

ভিকুনার পশম কেন এতটা মূল্যবান, জানেন কি? এই পশম থেকে তৈরি পোশাক দেহকে ঠাণ্ডার সময় দারুণ উষ্ণ রাখে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল এদের দেহে কিন্তু ভেড়ার মতো পশম তৈরি হয় না, এক বছরে মাত্র ১ পাউন্ড ওজনের পশম তৈরি হয় একটি ভিকুনার দেহে। এছাড়াও এই পোশাকগুলো বিশ্বের সবচেয়ে নরম পোশাক বলে বিবেচিত, এটাই এর চাহিদার মূল বিষয়। 

একটি ভিকুনার দেহ থেকে প্রতি ৩ বছরে একবার মাত্র পশম সংগ্রহ করা যায়। মূলত স্বল্পতার কারণেই এই পশমের মূল্য এতো বেশি। এর পাশাপাশি এদের খামারে রেখে চাষ করাও সম্ভব নয়, কারণ ভিকুনারা মুক্ত অবস্থায় না থাকলে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে না। তার ওপর দক্ষিণ আমেরিকার এই অঞ্চলের আন্দিজ পর্বতমালায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,০০০ ফুটের বেশি উচ্চতাতেই কেবলমাত্র এই প্রাণীটিকে দেখতে পাওয়া যায়। বলতে গেলে প্রতিবছর ঠিক কতটা পরিমাণে ভিকুনার পশম সংগ্রহ করা সম্ভব হবে তা এক রকম অনিশ্চিত। এই সমস্ত কারণেই এদের দেহের পশমের দাম আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।


ভিকুনার পশমের তৈরি পোশাক এখনো মূল্যবান কাপড়ের মধ্যে অন্যতম। এই প্রাণীটি সব দেশে হয় না। মাত্র কয়েকটি দেশেই এরা টিকে থাকতে পারে। বিশেষ করে অতিরিক্ত গরম অঞ্চলে এরা বাঁচতে পারে না। এদের পশমই নিজের শরীর অনেক বেশি গরম রাখে। বুঝতেই পারছেন কতটা মূল্যবান ছিল এই কাপড়। শুধুমাত্র রাজ পরিবারের সদস্যরাই এই পোশাক পরতে পারত। যা তাদের আভিজাত্য প্রকাশ করত। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.