থ্রিলার উপন্যাসে নিজের করা খুনেরই ক্লু দিয়েছিলেন লেখক

Odd বাংলা ডেস্ক: পাহাড়ের কোল ঘেঁষা ছোট্ট জনপদ হুজোউ। চিনের জিঝিয়াং প্রদেশের একটি শহর। সারাবছরই  লেগে থাকে পর্যটকদের আনাগোনা। ১৯৯৫ সালের ২৯ নভেম্বর সেখানেই ঘটে গেল এক মর্মান্তিক ঘটনা। ছোট্ট একটি অতিথিশালায় নির্মমভাবে খুন হলেন চার ব্যক্তি— হোটেলের মালিক, তার স্ত্রী, ১৩ বছরের নাতি-সহ এক পর্যটক। প্রত্যেককেই খুন করা হয়েছে একইভাবে। করোটিতে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে।

তবে কে বা কারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটালো কিংবা কারা জড়িত তার হদিস মিলছে না কিছুতেই। এই রহস্যের সমাধান করতেই রীতিমতো ঘাম ছুটে যায় চীনা পুলিশদের। কোনো প্রমাণ ছিল না কোথাও। প্রান্তিক জনপদের হোটেলে তখনও ব্যবহার শুরু হয়নি সিসিটিভি ক্যামেরার। ছিল না নাম রেজিস্টারের ব্যবস্থাও। শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালে যবনিকাপতন হয় এই মামলার। সৌজন্যে, একটি থ্রিলার উপন্যাস। আর অপরাধী? অন্য কেউ নন, স্বয়ং সেই গ্রন্থের লেখক লিউ ইয়ংবিয়াং।

২০১০ সাল। প্রকাশিত হয়েছিল ইয়ংবিয়াং-এর সম্পূর্ণ উপন্যাস ‘দ্য গিল্টি সিক্রেট’। যে কাহিনির মূলে ছিল চীনের হুজোউ হত্যাকাণ্ডের পটভূমি। তবে অপরাধকাহিনির লেখক হিসাবে লিউ-এর আত্মপ্রকাশ একুশ শতকের শুরু থেকেই। তৎকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হত তার লেখা ছোটগল্প। আর তা সবই ছিল প্রায় থ্রিলার স্টোরি। তবে লিউ-এর জনপ্রিয়তা এক ধাক্কায় বাড়িয়ে দিয়েছিল ‘দ্য গিল্টি সিক্রেট’। এমনকি ‘বেস্টসেলার’ এই গ্রন্থ প্রকাশের মাত্র দু’বছরের মধ্যেই চীনের খ্যাতনামা সাহিত্যিক সংগঠনের সম্পাদকের পদেও বসানো হয় লিউকে।

কিন্তু কীভাবে হত্যাকাণ্ডের রহস্যভেদের হাতিয়ার হয়ে উঠল ‘দ্য গিল্টি সিক্রেট’? এই উপন্যাসের শুরুতেই ছিল এক অদ্ভুত প্রিফেস। ‘দ্য বিউটিফুল রাইটার হু কিলড’। হ্যাঁ, গল্পে খুনির আসনে লিউ বসিয়েছিলেন এক তরুণী লেখিকাকে। আর নিজের লোপাট করা সমস্ত প্রমাণ, রহস্য সমাধানের সূত্রও তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ লিপিবদ্ধ করেন উপন্যাসে। 

২০১০ সালে উপন্যাসটি প্রকাশের পর শুরুতে একেবারেই বিষয়টা নজরে আনেনি পুলিশ প্রশাসন। হুজোউ হত্যাকাণ্ড নিয়ে তৎকালীন সময়ে প্রচলিত একাধিক কনস্পিরেসি থিওরি। এই গ্রন্থের কাহিনিকেও ঠিক তেমনটাই ভেবেছিলেন চীনা গোয়েন্দারা। বার বার রহস্যভেদে ব্যর্থ হয়েই এই উপন্যাসের স্মরণাপন্ন হন ভারপ্রাপ্ত ডিটেক্টিভ। তবে লেখকই যে স্বয়ং খুনি, তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তিনি। নিছক অপরাধের জাল গোটানোর রেফারেন্স পেতেই তিনি সাহায্য নিয়েছিলেন এই উপন্যাসের। আর তারপরই দরজা খুলে যেতে থাকে একটু একটু। শেষ পর্যন্ত একটি পোড়া সিগারেটের বাট এবং জিন টেকনোলজি তাকে পৌঁছে দেয় লিউয়ের কাছে।

আর লিউ? গ্রেপ্তারের সময় হাসি মুখেই স্বীকার করে নেন গোটা ঘটনাটি। এমনকি উদাত্ত কণ্ঠে জানান, এই দিনটির জন্যই এত বছর অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। তবে শুধু লিউ নয়, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তার আরও এক সঙ্গী ওয়াং মোউমিং। তিনিও বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত নিজের কর্মক্ষেত্রে। তিনি তখন একজন জাঁদরেল আইনজীবী।তবে কি কারণে এই খুন? কেন সমাজের দুই প্রতিষ্ঠিত দুই ব্যক্তি সাধারণ এক হোটেল মালিক এবং তার পরিবারকে খুন করে বসল? 

চলুন ঘটনার সেই সময়ে ফিরে যাওয়া যাক। লিউ এর কথায়, যে সময় এই খুনের ঘটনা ঘটে তখন তাদের দু’জনেরই বয়স বেশ কম। বিলাসবহুল জীবনের জন্য অর্থের চাহিদা সেসময় অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়া তাদের। ঠিক সেভাবেই স্রেফ চুরি করতে হুজোউ প্রদেশের ওই হোটেলে পর্যটকের বেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। লক্ষ্য, রাতের বেলায় অন্যান্য অতিথিদের অর্থ হাতানো। কিন্তু সমস্যা বাঁধল অন্য জায়গায়। ছিনতাইয়ের সময় ঘুম ভেঙে যায় এক পর্যটকের। তখনই বদলে যায় পটভূমি। পালানোর চেষ্টা না করে, ওই ব্যক্তিকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন তারা। তালা ভাঙার হাতুড়ির আঘাতে গুঁড়িয়ে দেন ওই ব্যক্তির করোটি। কিন্তু গোঁঙানিতে তখন ঘুম ভেঙে গেছে হোটেলের মালিকের। প্রত্যক্ষদর্শীদের পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতেই বাকি তিনটে খুন। কিন্তু কাউকে হত্যা করা পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না তাদের। 

এই ঘটনার অপরাধবোধই বছরের পর বছর কুড়ে কুড়ে খেয়েছে লিউকে। তেমনটাই তিনি জানান আদালতে। এমনকি নিজের বিচারের সময় ন্যূনতম সাফাইটুকুও গাননি তিনি। মাথা পেতেই নিয়েছেন সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। ঠিক কবে সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল বা আদৌ এখনও তিনি জীবিত আছেন কিনা— তার কোনো তথ্যই আর প্রকাশ করেনি চীন সরকার। এমনকি মূল বইটিরও অস্তিত্ব মুছে দেয় প্রশাসন। তবে একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে ‘দ্য গিল্টি সিক্রেট’। আজও যা জনপ্রিয় সমানভাবে। এক কথায় এই কাহিনি শুধু থ্রিলারই নয়, বরং রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হওয়া ওঠার গল্প বটে। লিউ মূলত তার ঝোকের মাথায় করে ফেলা অপরাধের বোধ বয়ে বেড়াতে পারচ্ছিলেন না। নিজেকে ধরা দিয়েই এই উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি, এমনটাই মত সাহিত্য বোদ্ধাদের। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.