সম্রাট শাহজাহানের সিংহাসনে ২টি ময়ূর থাকত কেন?

Odd বাংলা ডেস্ক: পৃথিবীর ইতিহাসে বিস্ময়কর এক নিদর্শন হচ্ছে ময়ূর সিংহাসন। বিরল মনি-মুক্তা এবং স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত এই সিংহাসন একসময় ভারতের সম্পদ ছিল। যা তৈরি করেছিলেন মোঘল সম্রাট শাহজাহান। এখন কারো কারো মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কেন সম্রাট শাহজাহান এই সিংহাসনে ময়ূরের অবয়ব ব্যবহার করলেন, অন্য কোনো প্রাণী ব্যবহার করলেন না কেন? মোঘল আমলে শিল্প-সাহিত্যে ময়ূরের এক অনন্য স্থান ছিল, যা অন্য কোনো প্রাণীর ছিল না। মোঘল আমলে অঙ্কিত চিত্রকর্মগুলোতে ময়ূরের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হতো অনেক নিপুণভাবে। তখনকার সাহিত্যেও ময়ূর এক গুরুত্বপূর্ণ রূপ দান করে।

শামস-ই-তাবাসি একজন কবি। তিনি তার কাব্যগ্রন্থে দাবি করেন যে, বেহেশতের সবচেয়ে উঁচু স্তরে থাকবে ময়ূর। আর যেহেতু এই পাখিকে ধর্মীয়ভাবে বেশ গুরুত্ব দেয়া হতো, তাই মোঘল শাসনামলে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল যে, এই পাখির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে অবশ্যই সৃষ্টিকর্তা পরকালে ভালো কিছু করবেন। এজন্যই ধারণা করা হয়ে থাকে সম্রাট শাহজাহান তার বিখ্যাত সিংহাসনের পেছনে দুটো ময়ূরের অবয়ব তৈরি করিয়ে নেন। আর পরবর্তীতে এই পাখির নামেই সিংহাসনটির নামকরণ করা হয়।

বাছাই করা স্বর্ণকার ও জহুরিদের মাধ্যমে প্রায় সাত বছর সময় নিয়ে এই সিংহাসন তৈরি করেন। এতে বিশ্বের সবচেয়ে দামি হীরা কোহিনুর ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রায় এক হাজার ২০০ কেজি স্বর্ণ এবং ২৩৬ কেজি মূল্যবান পাথর দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। এছাড়াও ১১৬টি পান্না, ১০৮টি রুবি এবং আরো অসংখ্য মূল্যবান পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল, যেগুলোর অনেকগুলো ছিল অত্যন্ত দুর্লভ। এতে আগ্রার তাজমহলের থেকেও দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় হয়েছিল। সিংহাসনের পেছনে যে দুটো ময়ূর ছিল সেগুলোর লেজ ছিল ছড়ানো। আর এই কারণে সিংহাসনের সৌন্দর্য বেড়ে যায় বহুগুণ।

কথিত আছে, হযরত সোলায়মান (আ.)-কে অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন সম্রাট শাহজাহান। সোলায়মান (আ.) এর বিশাল সাম্রাজ্যের পাশাপাশি ছিল একটি রাজকীয় সিংহাসন, যেটি মোঘল সম্রাট শাহজাহানকে বেশ প্রভাবিত করে। এজন্য তিনি নিজেও বিশাল সাম্রাজ্যের পাশাপাশি একটি রাজকীয় সিংহাসনে বসে সাম্রাজ্য পরিচালনার স্বপ্ন দেখতেন। 

১৬২৮ সালে যেদিন সম্রাট শাহজাহান সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, সেদিনই প্রথম সেই রাজকীয় সিংহাসন প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়। সম্রাট শাহজাহানের চিন্তাধারা ছিল যে, এই সিংহাসন মোঘল সাম্রাজ্যের পরিচয়বাহী একটি কীর্তি হয়ে উঠবে। মোঘলদের ঐশ্বর্য সম্পর্কে বাইরের দুনিয়াকে ধারণা দেবে। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র সম্রাট আওরঙ্গজেব জিন-ব্যাপ্টিস্ট টাভের্নিয়ার নামের একজন ফরাসি অলংকারিককে আমন্ত্রণ জানান। ১৬৬৫ সালে তিনি ভারতবর্ষে আসেন। রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে ময়ূর সিংহাসন দেখার পর তার চোখ কপালে উঠে যায়।

১৭৩৯ সালে পারস্যের নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করেন। নাদির শাহ ছিলেন খুবই চতুর। মোঘল সাম্রাজ্যের মতো বিশাল সমৃদ্ধ এলাকা তার দখলে চলে আসলেও তিনি মূল এলাকা ছেড়ে দিয়ে এখানকার সিংহাসন দখল করতে চাননি। কারণ তাতে করে তার মূল সাম্রাজ্য অরক্ষিত হয়ে যেত এবং অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো দখলে সিংহাসন চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই তিনি মোঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি মুহাম্মদ শাহের সঙ্গে সন্ধি করেন এবং তাদেরকে সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দেন। এই সন্ধি অনুসারে মোঘলদের যেসব মূল্যবান সম্পদ ছিল তার বড় অংশ হস্তান্তর করতে বাধ্য হয় তারা। এর মধ্যে ময়ূর সিংহাসনও ছিল। এভাবেই অত্যন্ত দামী ও ঐতিহ্যবাহী ময়ূর সিংহাসন তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়।

১৯৭৪ সালে নাদির শাহ আততায়ীদের হাতে নিহত হন। এরপর রাজপ্রাসাদে বেশ অরাজকতা শুরু হয় এবং লুটের ঘটনা ঘটে। তখনই হারিয়ে যায় বিখ্যাত এই ময়ূর সিংহাসন। কারো কারো মতে, এটি টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে। আবার কেউ বলেন, চুরি হয়ে গিয়েছে সেই সব ভাঙা টুকরোগুলো। ভাঙা টুকরোগুলো পরবর্তীতে চড়া দামে বিক্রি করা হয়। মোঘল সাম্রাজ্যের অনুকরণে পরবর্তীতে ইরানেও ময়ূর সিংহাসন তৈরি করা হয়, যেটি এখন তেহরান জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ব্রিটেনের একটি জাদুঘরে ময়ূর সিংহাসনের একটি পায়া সংরক্ষিত আছে।


ময়ূর সিংহাসন ছিল মোঘল সাম্রাজ্যের জৌলুস তুলে ধরা এক কালজয়ী কীর্তি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মোঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে পরিবর্তন আসে। এক সময়ের পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য শক্তি হারিয়ে ইতিহাস থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। বিদেশি শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে মোঘলদের গর্বের ময়ূর সিংহাসনও হাতছাড়া হয়ে যায়। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.