মদন কামদেব: পাশের রাজ্য অসমের বুকেই আছে আরেক খাজুরাহ


Odd বাংলা ডেস্ক: অসমকে তন্ত্রমন্ত্রের রাজ্য বলা হয় সেই প্রাচীনকাল থেকে। এখানে এমন অনেক নিষিদ্ধ কাল্টের কথা শোনা যায় যা তন্ত্রবিদ্যার একেবারে প্রাচীন স্বরূপ। যেমন কামাক্ষা। কিন্তু শুধু  যোনি দেবী নয়। এই অসমের বুকেই আছে আরেক রহস্যময় মন্দির। যেখানে পরম আরাধ্য দেবতা হলেন কামদেব। কিন্তু এই কামদেবের পুজো কি আজ হয় ? অতীতের সেই কাল্ট আজ পরিণত হয়েছে ব্যবসায়। তবু ভারতকে কেন ল্যান্ড অব সেক্স বলা হয় সেটা বোঝা সম্ভব মদন কামদেবের মন্দিরের কারুকার্য দেখে। 


কে এই কামদেব 

• কামদেব প্রেম বা আরও নিবিড়ভাবে বললে বাসনার দেবতা। ভারতীয় পরম্পরায় উল্লিখিত ‘কাম’ যে কিছুতেই ‘পশ্চিম গোলার্ধের ‘সেক্সুয়ালিটি’-র সমার্থক নয়, সে কথা বার বার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। কাম কী, না জেনে কামদেবের পূজা সম্ভব কিনা, সেটাও ভেবে দেখার মতো ব্যাপার।

• কামদেব ‘কাম’ অর্থাৎ দেহজ ও দেহাতীত অনুভবের জগৎকে একত্রে মুক্ত করতে পারেন বলেই জানায় পুরাণসমূহ। অথর্ব বেদ-এ কামদেব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

• কামদেব বা মদনকে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীদেবীর সন্তান হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তবে তাঁর জন্ম নাকি তাঁদের কৃষ্ণ ও রুক্মিণী অবতারে মিলনের ফলে। আবার কোথাও কোথাও কামদেবকে ব্রহ্মার সন্তান বলেও বর্ণনা করা হয়েছে।  

• কামদেবকে মানুষের বাসনা-নির্ধারক গ্রহগুলির অধিপতি বলে বর্ণনা করা হয়। তিনি অতি সুদর্শন যুবাপুরুষ, এক আশ্চর্য তির-ধনুক তাঁর অস্ত্র। তাঁর ধনুক নির্মিত হয়েছে ইক্ষুদণ্ড দিয়ে, ধনুকের জ্যা মধু দিয়ে, তিরগুলি নির্মিত হয়েছে অশোক, পদ্ম ও আম্রমুকুল দিয়ে। কামদেবের বাহন টিয়াপাখি। তাঁর পত্নী রতিদেবীকে প্রেমের দেবী বলে মনে করা হয়।

• কামদেবের অধিষ্ঠানমন্ত্র হল ‘ক্লিং’। এই বীজ জপে নাকি কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি আকৃষ্ট হন।

• প্রাচীন ভারতে কামদেব রীতিমতো পূজিত হতেন। গুপ্তযুগে নগরে নগরে তাঁর মন্দির ছিল। প্রাচীন সাহিত্যগুলি থেকে জানা যায়, সেই মন্দিরগুলি ছিল সেকালের প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিয়মিত বিহারের স্থান। মদনোৎসব বা হোলি ছিল কামদেবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত উৎসব। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিকম’-এ গুপ্তযুগের মদনোৎসবের যে বর্ণনা রয়েছে, তার কাছে আজকের নাইট ক্লাবও তুচ্ছ। হোলি আজ ‘বসন্তোৎসব’। কামদেবের নাম আর তাতে সংশ্লিষ্ট নেই। কিন্তু উৎসব রয়ে গিয়েছে।

• কামদেব উপাসনা কিন্তু আজও বহমান। তবে তার উদ্দেশ্য ও বিধেয় মোটেই প্রাচীন কামদেব-উপাসনার অনুরূপ নয়। বিভিন্ন বিচিত্র কারণে কামদেব উপাসনা কুক্ষিগত হয়েছে এক শ্রেণির ‘ধর্মব্যবসায়ী’-র। বেশ ঘটা করে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁরা জানান, কামদেব-যজ্ঞ এবং কামদেব-বশীকরণ দ্বারা তাঁরা যে কোনও ব্যক্তির বাসনা চরিতার্থকরণের ব্যবস্থা করবেন। ফলে একদা যে কাল্ট এদেশের সংস্কৃতির একটা বড় জায়গাকে ধরে রেখেছিল, তা আজ তুকতাকের স্তরে নেমে এসেছে।

• তবে ভারতের কয়েকটি স্থানে কামদেবের মন্দির আজও বিদ্যমান। তামিলনাডুর আরাগালুরে কামেশ্বর মন্দিরে, বৃন্দাবনের বিখ্যাত ১২টি বনের অন্যতম কাম্যবনে, তামিলনাডুর থাড়িকোম্বুর সৌন্দর্য পেরুমল মন্দিরে এবং রাজস্থানের হরসত-মাতা মন্দিরে কামদেব আজও পূজিত।


মদন কামদেবের মন্দিরে হত কামোৎসব

গৌহাটি থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে দেওয়ানগিরিতে অবস্থিত এই মদন কামদেব মন্দির। এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে যতটুকু দেখা, তাতে গোটা মন্দির জুড়েই রয়েছে বিভিন্ন কাম উত্তেজক ভাস্কর্য্য। প্রতিটি গম্বুজ কামের আলাদা আলাদা রীতিকে প্রদর্শিত করেছে। মন্দিরের দেওয়ালে পাথরে খোদাই বিভিন্ন ভঙ্গিমায় কামের বিভিন্ন সূত্রের মূর্তিই এর দৃষ্টান্ত। মনে করা হয় প্রাচীনকালে তান্ত্রিকরা কামদেবের সাধন ভোজনে কাম কলার তন্ত্রে মন্ত্রে দীক্ষীত হতেন ও আশির্বাদ প্রাপ্ত হতেন। এই সময় এরা সম্পূর্ন নগ্ন হয়ে এই মন্দিরে অবস্থান করতেন। ভক্ত নারী ও পুরুষ তাঁদের নিজ হাতে আহার করাতেন।তখন তাঁদের জীবন্ত লিঙ্গেরও পূজা করা হত। তাঁদের ঘিরে কীর্তন হয় ও মন্ত্র পাঠও করা হত।

আরেকটি ভাস্কর্য্য শিল্পের নিদর্শন

ইতিহাসের বিভিন্ন পরিব্রাজকের লেখায় মদন কামদেব মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। চৈনিক পরিব্রাজকদের এক লেখায় এই মদন কামদেবে এক বিশেষ উৎসবের কথা বলা হয়ে থাকে। এর নাম কামোৎসব।  তান্ত্রিকরা দিগম্বর অবস্থাতেই সমস্ত উৎসব কাল মন্দিরের বাইরের সমস্ত জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। বিভিন্ন বাসনা নিয়ে আসা কিছু নারী তাঁদের কৃপা ও আশির্বাদ লাভের আশায় এই সকল তান্ত্রিকদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হতেন।পুরুষ তান্ত্রিকদের পাশাপাশি অনেক নারী তান্ত্রিকদেরও দেখা পাওয়া যেত সেই সময়।পুরুষদের ন্যায় তাদেরও অবাধ নগ্ন বিচরন থাকতো।পুরুষ ভক্তরা ঐ সকল দিব্যতা অর্জনকারী নারীদের যৌন সুখে তৃপ্ত করতে পারলে তাঁরা সেই সকল পুরুষ ভক্তদের তন্ত্রে মন্ত্রে দীক্ষিত করে তুলতেন। সেসবেরই উল্লেখ আছে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপিতে।  


সমকাম ও বিপরীতকাম উভয়ের উল্লেখ

প্রাচীন ভারতে সমকাম ছিল একটি স্বাভাবিক ঘটনা।এছাড়াও কামসূত্র গ্রন্থে সমকামিতার বেশ কিছু কাহিনীর বর্ণনা পাওয়া যায়।কথিত আছে কামদেব ও তার স্ত্রী রতী উভয়েই সমকামিতায়ও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।  তিন ধরণের তান্ত্রিক শক্তি প্রাপ্ত নারী পুরুষ কামরূপ কামাখ্যায় দেখতে পাওয়া যায়।তাঁরা যথাক্রমে রতী, অঘোরী ও সতী। রতী লাল বসন ধারন করেন, অঘোরীদের বসন হয় কালো আর সতীদের বসন হয় সাদা। আর সেই রীতিরই উল্লেখ মেলে কামদেব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে। এখানে এমন কিছু ভাস্কর্য্য আছে যা দেখলে বোঝা সম্ভব যে সমকামকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সমানভাবে।  

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.