সেদিন বিকাশ রায়ের অভিনয় দেখে বাঙালি দর্শক জুতো ছুঁড়ে মেরেছিল



Odd বাংলা ডেস্ক: জীবনে কোনও দিন তিনি মদ্যপান করেননি, অথচ রাস্তায় তাঁকে দেখলে কেউ কেউ বলতেন, ‘ওই দ্যাখ, বিকাশ রায় কেমন মাতালের মতন হাঁটছেন’। তাঁর মৃত্যুর পরে লিখেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ জন সেবাব্রত গুপ্ত। কিংবা প্রবীণ সিনেমারসিকের স্মৃতিতে আছে, হেমেন গুপ্তের ’৪২-এ বিকাশের অভিনয় দেখে কেউ কেউ জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন। কিন্তু ’৪২-এর পরে বিকাশ রায় যেন বাংলা ছবির এক দাগী খলনায়ক হিসেবেই পরিচিত হয়ে রইলেন। অথচ তাঁর মধ্যে ছিল এক অপূর্ব একা, বহু বিচিত্র চরিত্রে তাঁর অভিনয়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় তাকে। বিজয় বসুর ‘আরোগ্য নিকেতন’, অসিত সেনের ‘উত্তর ফাল্গুনী’, চিত্ত বসুর ‘ছেলে কার’, রাজেন তরফদারের ‘জীবনকাহিনি’ কিংবা তাঁর নিজেরই পরিচালিত ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ তার সাক্ষ্য দেবে। ১৯১৬-তে এ শহরের ভবানীপুরে জন্ম, কর্মজীবনের শুরু অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র নাটক বিভাগে। জ্যোতির্ময় রায়ের ‘অভিযাত্রী’তে প্রথম চলচ্চিত্র-অভিনয়। তার পরে অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে অভিনয় করেছেন মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে। পাশাপাশি চলেছে আবৃত্তি, পাঠ ও শ্রুতিনাটক।
১৯৮৪ সালে অভিনয় জগৎ থেকে অবসর নিয়েছিলেন বিকাশ রায়। ঠিক আজকের দিনে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কথা বলতে পারবনা, কিন্তু দুহাজার সালের কিছুদিন আগে পরেও লোকে তাঁকে একডাকে চিনত বাংলা সিনেমার এক জনপ্রিয় অভিনেতা হিসেবে। কে বিকাশ রায়? জিজ্ঞাসা করতে বা ভাবতে হয় না কেন ? কি আছে তাঁর অভিনয়ে যা তাঁকে আবছা হতে দেয়নি বা মুছে যেতে দেয়নি ওপর ওপর দেখলে বলা যায়, যে কোনো চরিত্রে, ছোট-বড়, নায়ক, ভিলেন - বিকাশ রায় একটা ছাপ রেখেছেন তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও অভিনয় ক্ষমতার জোরে। সেই যুগে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত বিকাশ রায়, শুধু মাত্র হৃদয় বা মন দিয়ে অভিনয় করেননি - তাঁর অভিনয়ের মধ্যে আমরা তাঁর বিচক্ষণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার ব্যবহার সুস্পষ্ট দেখতে পাই। একই ধরনের চরিত্রে সামান্য একটু বাচন ভঙ্গি বা অঙ্গ ভঙ্গি রদবদল করেই, চরিত্রটিকে অনন্য করে তুলতেন। আমরা আর একটু পরে এই রাস্তা ধরে আরো আলোচনা করব, কিন্তু তার আগে আমরা ওঁর এই জনপ্রিয়তার ব্যাপারটা আর একটু তলিয়ে দেখতে চাই। বিকাশ রায়ের লেখা বই আর অন্য কিছু কাগজের কাটিং আমাদের কাছে আছে, তার থেকে আমরা অনেক কথা জানতে পেরে এই লেখায় ব্যবহার করেছি।

বিকাশ রায়ের মৃত্যুর পরে পরেই পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আর ইংরেজী কাগজে তাঁকে নিয়ে যা লেখা হয় তার প্রায় সব কটায় তাঁর মনে রাখার মত ছবির একটা করে তালিকা দেওয়া হয়। তার মধ্যে প্রধান কিছু কাগজ, যথা অমৃতবাজার, আনন্দবাজার, উল্টোরথ -- এগুলোতে সব মিলিয়ে তাঁর চল্লিশটি ছবির নাম পাওয়া যাচ্ছে তাঁর স্মরণীয় ছবি বলে [১]। এ তালিকা তৈরী করা হয়েছে মৃত্যুর পরেই, তখন লোকে খুব শোকার্ত। তা না হলে, এমনি সময়ে তৈরী করলে আরো অনেক ছবি যোগ হতে পারতো-- তা ছবি ভালো না চললেও, শুধু বিকাশ রায়ের অভিনয় নিয়ে প্রশ্ন করলে। আমার মনে হয় যে বিকাশ রায়ের নাম আজও লোকে এতো মনে রেখেছে কেননা তাঁর এতো মনে রাখার মতো ছবি আছে বলে। সবাই অবশ্য এর সব ছবি দেখেননি, কিন্তু যত বেশি ভালো ছবি হবে তত বেশী লোকে দেখবে আর মনে রাখবে, এমনটাই আশা করা যায়। তার মানে অভিনেতা বিকাশ রায়ের কথা বললে প্রায় সবাই স্মৃতিতে তাঁর একটা-দুটো ভালো ছবি দেখে আনন্দ পাবার কথা খুঁজে পাবেন।

স্মরণীয় ছবির তালিকা এত বড় হল অবশ্যই গুণের বিচারে। কিন্তু বিচার করার মতো ছবিও হয়েছে অনেক। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিকাশ রায়ের দুশো আটচল্লিশটি ছবি রিলিজ হয়েছে, সংখ্যাটা উপেক্ষা করার মত নয়। যত বেশী ছবিতে অভিনয় করবেন, ভালো ছবির সম্ভাবনা ততই বাড়বে, দর্শকের মনে দাগ রেখে যাবার মত ছবির সংখ্যা ততই বেশী হবে। বিকাশ রায়ের ক্ষেত্রেও এইরকম ঘটেছিল। বিশেষ করে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ (তাঁর নিজের মতে ১৯৬০-৭০) পর্যন্ত সিনেমার অভিনেতা হিসেবে তাঁর সবচেয়ে ভালো সময়। এই সময়ে তিনি দেড়শো মত ছবি করেছেন, আর ওপরের তালিকার প্রায় সব ছবিই এই সময়ের থেকে। অবশ্যই অনেক ছবি ছবি হিসেবে খুব ভালো হয়নি, ছবি হয়তো ভালো চলে নি -- তিনি তো মাত্র অভিনেতা, ছবির সব ভালোমন্দ তো তাঁর হাতে নয়। তবে ভালো ছবি অনেক হয়েছে, এটাই আসল কথা।

পঞ্চাশ দশকে, বিশেষত গোড়ার দিকে তিনি অনেক ছবিতে নায়কের পার্ট করেন তার অনেকগুলোই খুব সফল, যথা রত্নদীপ, রাত্রির তপস্যা, ছেলে কার, ইত্যাদি। কিন্তু এর পর নায়ক হিসেবে উত্তমকুমারের খ্যাতি বাড়তে শুরু করার পর নায়কের ভূমিকা ওঁরই মোটামুটি একচেটে হয়ে যায়। কিন্তু ভিলেন বা অন্য সব পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতার দরকার হয়। এ সব পার্শ্বচরিত্র হতো নানা রকম টাইপের। সিনেমায় নামার প্রায় শুরু থেকেই, অর্থাৎ ভুলি নাই বা '৪২ ছবি থেকে ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করে বিকাশ রায়ের খুব নাম হয়েছিল। তারপর উনি দেখালেন যে শুধু নানা ধরণের ভিলেন চরিত্র নয়, তাছাড়াও অন্য প্রায় যে কোনো পার্শ্বচরিত্রে তিনি খুব সার্থক অভিনয় করতে পারেন -- সে একদিকে স্যুটবুট পরা ইংরেজী-আওড়ানো অভিজাত লোক থেকে আরম্ভ করে নেশাখোর সাপুড়ে পর্যন্ত, উদাহরণ সূর্যতোরণ ছবির রাজশেখর বা শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথ-অন্নদাদিদি ছবির শাহজী। আমার যতদূর মনে আসছে সে সময়ে এত রকমের চরিত্রে একজনই রূপ দিতে পারেন এমন অভিনেতা উনি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না বললেই হয় (হয়তো উৎপল দত্ত, কিন্তু তিনি স্টেজের অভিনয়েই ব্যস্ত থাকতেন)। কাজেই ভিন্ন ভিন্ন ছবিতে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার জন্য বিকাশ রায়ের ডাক পড়তো বেশী।

তারপর বিকাশ রায় সম্বন্ধে তাঁর সহকর্মীরা কী বলেছেন তার থেকে জানলাম যে যাঁরা তাঁকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতেন তাঁরা তাঁর প্রফেশন্যাল কাজ নিয়ে খুব খুশী ছিলেন। মৃণাল সেন বলছেন: " খুব সিরিয়াস মানুষ। শটের ডিটেল্‌স খুব মনোযোগ সহকারে শুনে নিতেন। তারপর সহশিল্পীদের সঙ্গে সংলাপ উচ্চারণ করে নিতেন। এরপর ক্যামেরা মুভমেন্টের সঙ্গে দু’-একটা মনিটর হবার পর ফাইনাল টেকিং হত। ওঁর সঙ্গে কাজ করতে কোনো সময়েই আমাকে সমস্যায় পড়তে হয়নি।" আর তপন সিংহ: " বিকাশ রায় বরাবরই খুব মেথোডিক্যাল। একবারের বেশি দুবার তাঁকে কোনো কথা বলতে হত না। ফিল্ম-সেন্সটা ছিল প্রখর।" দুই প্রথম শ্রেণীর পরিচালকের এই মত থেকে আমরা বুঝি যে তাঁকে নিয়ে কাজ করে পরিচালকেরা খুশী হতেন, অন্য কলাকুশলীরা, যথা ক্যামেরাম্যান বা শব্দযন্ত্রীরাও এই ধরণের কথা বলেছেন। এটা অবশ্য আশা করা যায় কেননা বিকাশ রায়ের নিজের লেখা থেকে জানছি যে তাঁর পেশায় দক্ষ হবার জন্য তিনি বিশেষ চেষ্টা করতেন। যেমন, তাঁর কণ্ঠস্বরের খুব নাম ছিল। তিনি লিখেছেন রেডিয়োতে কাজ করার সময় তিনি অনেক খেটে মাইক্রোফোন ব্যবহারের কৌশল শেখেন। আবার সিনেমা শুরু করেই তিনি সমস্ত ব্যাপারটা জানবার জন্য সামান্য পারিশ্রমিকে পরিচালক হেমেন গুপ্তের সহকারী হয়ে শিক্ষানবিশী করেন ৪২ ছবিতে। আর তাঁর প্রচুর পড়াশোনা তাঁকে চরিত্রের ভেতরে গভীরভাবে প্রবেশ করার কাজে সাহায্য করত।

এ তো গেলো টেকনিকের কথা। এর সঙ্গে আরো ছিল তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার। এ বিষয়ে অনেকে বলেছেন, যথা: "যে ছবিতেই তিনি অভিনয় করতেন, সেই সমস্ত ছবির সহ-শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর সহযোগিতা ছিল আমার মতে শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত" [রঞ্জিত মল্লিক]; "খুবই স্নেহপ্রবণ ছিলেন।" [সন্ধ্যা রায়]; "শিল্পী এবং কলাকুশলীদের সঙ্গে ওর খুবই সুন্দর সম্পর্ক রয়েছে। সিনিয়র আটিস্টদের সঙ্গে ওর র‌্যাপোর্টটা দেখার মতো ছিল। " [অসিতবরণ ]|

এরকমভাবে বিশ্লেষণ করে আমরা দেখছি যে নিছক অভিনয় ভালো করতে পারা ছাড়াও তিনি ছিলেন চরিত্রচিত্রণে ভার্সেটাইল, সিনেমা তোলার কাজকর্মের খুঁটিনাটি বুঝতেন বলে তাঁকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া সহজ ছিল আর মানুষ হিসেবে সহকর্মীদের শ্রদ্ধা আর স্নেহের পাত্র ছিলেন। সে জন্য নায়ক না হতে পারলেও অনেক ছবিতে তাঁর ডাক পড়তো, তিনি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ভালো অভিনয় করে ভালো ছবি তৈরীতে সাহায্য করতেন। তার ফলে তাঁর অভিনীত ভালো ছবি অনেক, সেই ভালো ছবির স্মৃতি আছে এমন দর্শকও অনেক আর তাঁরা বিকাশ রায়কে ভালো করে মনেও রেখেছেন। এইভাবে আমাদের প্রশ্নের একটা উত্তর পাওয়া গেল।

ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ- বা বাচনভঙ্গি ব্যবহার করে বিকাশ রায় একই ধরণের চরিত্রকে রূপায়িত করতেন বলেছিলাম আগে। তার একটা উদাহরণ মনে আসে, তা হলো '৪২ ও ইন্দ্রনাথ-শ্রীকান্ত-অন্নদাদিদি| ছবি দুটিতেই বিকাশ রায় ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করেন, কিন্তু কত পার্থক্য তাঁর চরিত্র চিত্রণে। ৪২ -এ তিনি ক্ষমতাসীন, ক্রূর একজন পুলিশ অফিসার, মেজর ত্রিবেদী । মেজর ত্রিবেদী অর্থাৎ বিকাশ রায় ধীরে ধীরে চিবিয়ে চিবিয়ে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে কথা বলার মধ্যে দিয়ে জানিয়ে দেন যে যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা তিনি রাখেন। আবার ইন্দ্রনাথ-শ্রীকান্ত-অন্নদাদিদিতেও বিকাশ রায় ভিলেন। এখানে তিনি ধূর্ত, চক্রান্তকারী, চরিত্রহীন। এই ছবিতে সাপুড়ের বেশে বিকাশ রায় শুধু মাত্র দৃষ্টিভঙ্গিমা দিয়েই তাঁর স্ত্রী অন্নদাকে ঘর ছাড়া করেন। দুটি চরিত্রই ভিলেন-এর কিন্তু অভিনয় ও বাচন ভঙ্গির পরিবর্তন করে বিকাশ রায় তাদের দুটি ভিন্ন ধরনের ভিলেন চরিত্রে পরিবর্তিত করেছেন।

তাঁর প্রায় আড়াইশো ছবি ধরে হিসেব দেওয়া প্রায় অসম্ভব কিন্তু তাঁর অভিনয়ের প্রসার যে কতখানি ছিল, কয়েকটা ছবির উদাহরণ দিলে তা নিয়ে সন্দেহ থাকবে না। বিকাশ রায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিন্তু তাঁর বিশেষ খ্যাতি ভিলেন বা পার্শ্বচরিত্র অভিনয়ে। ভিলেনের ভূমিকায় অভিনীত - ভুলি নাই, জিঘাংসা, ইন্দ্রনাথ-শ্রীকান্ত-অন্নদা-দিদি, অভয়া -শ্রীকান্ত, বধূ, রাজদ্রোহী, কাঁচের স্বর্গ, পাড়ি, অদ্বিতীয়া ছবিতে তাঁর অভিনয় আজও ভোলা যায় না| '৪২ ছবির কথা আগে বলেছি, সেখানে তাঁর জীবন্ত চরিত্রচিত্রণের ফলে অনেক দর্শকেরাই ছবি চলা কালীন তাদের রাগ ও ঘৃণা চেপে রাখতে পারতেন না। ইন্দ্রনাথ-শ্রীকান্ত-অন্নদাদিদি ছবিতে "সাঁপের খেলা দেখবে" কথাগুলি, সাপুড়ের বেশে বিকাশ রায়র বিশেষ বাচনভঙ্গি ও সেই দৃশ্যে তার চোখের দৃষ্টি, কি ভয়ানক ! সাপের চোখকেও হার মানায় । এই ছবিতেই সাপের কামড়ে মৃত্যুর সময় সাপটিকে টেনে ছিঁড়ে মেরে ফেলার সময় তাঁর অভিনয় অতুলনীয়। বধূ ছবিতে হাত কচলে-কচলে কি পরিমাণই না বিষ ছড়িয়েছিলেন। না ও রত্নদীপ ছবিতে ভালোমন্দ মেশানো মানুষের চরিত্রে বিকাশ রায় অনবদ্য। তিনি তা কত সহজে, কত সংযত অভিনয় দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা বোধয় ওঁর দ্বারাই সম্ভব ছিল। না ছবিতে একটি সহজ সরল মানুষ কি ভাবে ধীরে ধীরে একটি অমানুষে পরিণত হয়ে যাচ্ছে তা বিকাশ রায় সহজে ফুটিয়েছেন। রত্নদীপে তিনি এক প্রতারকের চরিত্রে অভিনয় করেন। যদিও এই ছবিতে চরিত্রটি প্রধানত ভিলেন-এর কারণ তিনি প্রতারক কিন্তু এই চরিত্রে উনি প্রেমিকের অভিনয়ও করেছিলেন। ছবিটি বক্স অফিস হিট হয়েছিল। বিভাস ছবিতে বিকাশ রায় একটি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন। এই ছবিতে, উত্তমকুমার-এর সাথে এক দৃশ্যে "হেরে গেলে দুয়ো দুয়ো " বলার সময়, তাঁর বাচনভঙ্গি প্রমাণ করে দেয় যে তিনি কত উচ্চমানের অভিনেতা ছিলেন। শেষ অঙ্ক ছবিতে বিকাশ রায় এক ডিটেকটিভের ভূমিকায় অভিনয় করেন। যেহেতু বিকাশ রায়, দর্শকের অনুমানে তিনিই নায়কের শত্রু। কাঁচকাটা হীরে ছবিতে ভিলেন মনে হলেও তা ছিল দুই প্রজন্মের সংঘাত। এখানেও বিকাশ রায় সংযত অভিনয় দ্বারা চরিত্রটিকে বিশেষত্ব প্রদান করেন।

আঁধারে আলো, জীবন তৃষ্ণা, সূর্যতোরণ, মায়ামৃগ, স্মৃতিটুকু থাক, উত্তরফাল্গুনী, জীবন কাহিনী, সন্ধ্যাদীপের শিখা, প্রস্তর স্বাক্ষর, বাঘিনী, দাদু, পরিণীতা, নবরাগ, আলো আমার আলো, হার মানা হার, দেবদাস প্রভৃতি ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রগুলিকে বিকাশ বাবু নিজের অভিনয় ক্ষমতা ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রয়োগে এক-একটি অসাধারণ চরিত্রে পরিণত করেন। বিকাশ রায় ল পাশ করেছিলেন, তাই বোধহয় উত্তরফাল্গুনী ছবিতে ব্যারিস্টার-এর অভিনয় এত স্বাভাবিক হয়েছিল। আরোগ্য নিকেতন ছবিটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পায়। তাঁর অভিনীত মশায় চরিত্রটি এই ছবিতে অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ। বনপলাশীর পদাবলী ছবিতে উত্তম কুমার নায়ক হলেও, বিকাশ রায় অভিনীত গিরিজা চরিত্রটি অন্যান্য চরিত্রগুলিকে এক সূত্রে বেঁধে রাখে। মায়ামৃগ ছবিতে দরিদ্র, পঙ্গু আত্মসম্মান-সম্পন্ন পিতার ভূমিকায় মন ভেজানো অভিনয় করেন। পরিণীতা ছবিতে দারিদ্র্য জর্জরিত সংসারের কর্তার চরিত্র রূপায়ণ ভোলার নয় ।

জীবনকাহিনী ও দাদু প্রায় একই রকম চরিত্র কিন্ত উপস্থাপনার গুণে ভিন্ন-ভিন্ন চরিত্র রূপে দর্শক সম্মুখে উপস্থিত হন। ওগো বধূ সুন্দরী ছবিতে কৌতুক প্রিয় দাদুর অভিনয়ে দেখে নিজেদের দাদুর কথা মনে পড়িয়ে দেয়। স্মৃতিটুকু থাক, আলো আমার আলো, মন নিয়ে, ছবিগুলিতে দরদী ডাক্তারের ভুমিকায় তাঁর অভিনয় সবার ভালো লাগে।কমেডিয়ান চরিত্রে তাঁকে দেখা গেছে ছদ্মবেশী-তে জামাইবাবুর চরিত্রে। কতজনেই বা জানে যে জামাইবাবু বা "পূজ্য জিজাজী"-কে প্রথমে বাংলা ছবিটিতেই দেখা যায়। চুপকে চুপকে হিন্দি ছবি পরে তৈরী হয়। বাগদাদ ছবিতে বম্বে-এর নায়িকা বেগম পারাকে তাঁর নায়িকা রূপে দেখা যায়। অত্যন্ত জনপ্রিয় ছেলে কার ছবিতে আমরা বিকাশ রায়-এর মুখে গান শুনি।

এটাও মনে রাখতে হবে যে বিকাশ রায় অভিনয়ের সঙ্গে-সঙ্গে ছবির প্রযোজনা, পরিচালনা, কাহিনী-রচনা ও চিত্রনাট্য রচনাও করেছেন। অনেকে এই সূত্রে তাঁকে মনে রাখেন। বিকাশ রায় প্রোডাকশন -এর ছবি গুলি বিভিন্ন প্রকারের। অর্ধাঙ্গিনী ও সূর্যমুখী পারিবারিক ছবি, বসন্ত বাহার সংগীতবহুল। মরুতীর্থ হিংলাজ মানুষের মনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত-প্রেম নিয়ে একটি নিটোল ভ্রমণ কাহিনী। এইটি super hit ছবি। ছবিটির গান গুলি অবিস্মরণীয়। চলচ্চিত্র নির্মাণে তার অদ্বিতীয় নৈপুণ্য। ঐতিহাসিক উপন্যাস কেরিসাহেবের মুন্সী অবলম্বনে তৈরী ছবির চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও প্রযোজনা তিনিই করেন। নতুন প্রভাত ও উত্তমকুমার অভিনীত রাজা-সাজা ছবির কাহিনী রচনা করেন বিকাশ রায় । তা ছাড়া বহু ছবির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন - যেমন কাজললতা, বিন্দুর ছেলে, দুই পুরুষ। পর্দায় অভিনয় ছাড়াও বিকাশ রায় রেডিও ও মঞ্চেও অভিনয় করেন। মঞ্চে চারটি নাটকই খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো। এছাড়া তিনি "শেষের কবিতা" উপস্থাপিত করেন ও নিজে ভাষ্যকারের অংশ পাঠ করেন। এধরণের প্রযোজনার তিনিই বোধহয় প্রথম উদ্যোক্তা। এই শ্রুতিনাটক লং-প্লেয়িং রেকর্ড-এ বেরোয়। তাঁর দুতিনটি গ্রামোফোন রেকর্ডও আছে। এসব সূত্রেও বিকাশ রায়কে বাংলার মানুষ মনে রেখেছে।

খুব নিকট পরিবারের লোক হিসেবে বলতে পারি মানুষ বিকাশ রায় অত্যন্ত স্নেহশীল ও family-oriented ছিলেন। তিনি সহজ অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেছেন। আহ্নিক দিয়ে তাঁর সকাল শুরু হত। অতি স্বল্পাহারি ছিলেন। শুটিং-এর সময় তাঁর খাবার বাড়ি থেকে যেত। তাঁর মতে "প্রযোজক-এর গলায় পা দিয়ে খাওয়া আমার পোষায় না"। উনি কোনদিন মদ্যপান করেননি - স্বাদ কেমন তাও জানতেন না। আত্মীয় স্বজন , বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাড়িতে দুর্গা পূজাও করেছিলেন। পুজোর সময় সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত মায়ের মূর্তির সামনে বসে তন্ত্রধারক হয়ে তাঁর সুললিত কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ করতেন আর পূজার খুঁটিনাটি ঠিক হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখতেন। সেই সঙ্গে অতিথি অভ্যাগতদের ঠিক মত সমাদর হচ্ছে কিনা তাও দেখতেন। পূজার দিন গুলিতে বাড়িতে নিরামিষ রান্নার নিয়ম ছিল। অতিথিরা সবাই পাত পেড়ে প্রসাদ পেয়ে যেতেন। তাঁর একটা সুন্দর মিষ্টি ব্যক্তিত্ব ছিল যা তাকে একাধারে রাশভারী ও অন্য দিকে বিশেষ স্নেহশীল করেছিল। বয়স্কদের প্রতি তাঁর ব্যবহার শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমপূর্ণ ছিল। ছোটদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল বন্ধুর মত।

অবসর সময় তাঁর বিভিন্ন বই পড়ে কাটত। আমাদের তাঁকে মনে আছে বসার ঘরে কোলবালিশ-এ বই রেখে পড়তে। ঘরে ছিল তাঁর বড় বড় বই-এর আলমারি - তাতে পুরাণ , উপনিষদ , মহাভারত , রামায়ণ ও আরও নানা রকম বই। তিনি লিখতে ভালবাসতেন। তাঁর আত্মজীবনী "মনে পড়ে" , "আমি" ও "কিছু ছবি কিছু গল্প" । শেষজীবনে শরীর খারাপ তো ছিলই আর তার ওপরে প্রিয়তমা কন্যার অকালমৃত্যুতে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন কিন্তু ভেঙে পড়েননি। যতদিন বাংলা সিনেমার দর্শক আছে ততদিন বিকাশ রায়ও আছেন, এটা বলতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু বিদেশে যেমন দেখছি টিভির বিশেষ বিশেষ চ্যানেল, ডিভিডির নানান প্রকাশন, এসবের মারফতে আজকের দর্শক বহু পুরনো ছবি দেখে তখনকার ছবির জগতের কুশলীদের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পান, বাংলায় কখনো তা হবে বলে মনে হয় না। নতুন প্রজন্ম এঁদের কাজের কথা জানতেই পারবেন না। তবে বাংলা ছবির সৎ ইতিহাস লেখা হলে সেখানে বিকাশ রায় প্রথম সারিতে থাকবেন এটা জানি। আর আজ তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে আমার মত আরো লক্ষ লক্ষ বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে আমরা যতদিন আছি, তিনি আছেন এবং থাকবেন, এটাও জানি!
Blogger দ্বারা পরিচালিত.