বিশ্বের সবচেয়ে অদ্ভুত কয়েকটি গাছ

 


ODD বাংলা ডেস্ক:  মানবসভ্যতার বিকাশের পিছনে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের গুরুত্ব অপরিসীম। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং বিনোদন মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা মেটাতে এই বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। প্রায় ৩০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে আবির্ভূত বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সূর্যের আলোকে জৈবিক শক্তিতে রূপান্তর শুরু করেছিল। 

প্রাণী জগতের সব সদস্যই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই জৈবিক শক্তি ব্যবহার করেই তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। জীববিজ্ঞানীরা এই উদ্ভিদজগতের সদস্যদের তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন- গুল্ম, লতা এবং বৃক্ষ। এই তিন ধরনের মধ্যে বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদই আমাদের বেশি পরিচিত। আমাদের পৃথিবীতে কিছু অভিনব চেহারা এবং বৈশিষ্ট্যধারী উদ্ভিদ রয়েছে। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক বিশ্বের এমন কিছু অদ্ভুত গাছ সম্পর্কে-


এই গাছগুলো দেখতে বোতল আকৃতির। এই গাছগুলোর কাণ্ডের নিম্নভাগ জলের বোতলের মতো মোটা, যা ধীরে ধীরে চিকন হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। এমন অদ্ভুত আকৃতির কারণে স্থানীয়রা এ গাছগুলোর নাম রেখেছে বাওবাব গাছ। এদের বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাডানসোনিয়া। এরা মূলত শুষ্ক মরু এলাকায় বসবাসের উপযোগী হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে। এই গাছগুলো তাদের বোতল আকৃতির কাণ্ডের ভিতর প্রচুর পরিমাণ জল ধরে রাখতে পারে। 


মরু এলাকায় জীবনধারণের জন্য এই জল এক কথায় অপরিহার্য। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে এই জল নিরাপদ রাখতে বোতল গাছগুলো বিষাক্ত এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে দেয়। এটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় আফ্রিকাতে। তবে এই গাছের এক প্রজাতি অস্ট্রেলিয়াতেও পাওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী গোত্রের শিকারিরা প্রায়ই এই বিষাক্ত পদার্থটি তাদের তীরের ফলায় ব্যবহার করে। 


এই জাতীয় গাছের বৈজ্ঞানিক নাম কুয়ারকাস। দক্ষিণ ক্যারোলিনার চার্লসটন কাউন্টির অন্তর্ভুক্ত জনস আইল্যান্ড দ্বীপে অবস্থিত গাছটির বয়স প্রায় ৫০০ বছর। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০ মিটার বা ৬৭ ফুট উঁচু এই গাছটি শুধু কাণ্ডের পরিধি সাড়ে আট মিটার বা প্রায় ৩০ ফুট। এই ওক গাছটির দীর্ঘতম শাখার দৈর্ঘ্য ১৮৭ ফুট। আর সব মিলিয়ে ওক গাছটির ছায়ায় ঢেকে থাকা জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ২০০ বর্গফুট বা এক হাজার ৬০০ বর্গ মিটার। 


এই জমির মালিক ছিলেন জাস্টাস অ্যাঞ্জেল এবং তার স্ত্রী মারথা ওয়াইট টাকার অ্যাঞ্জেল। অ্যাঞ্জেল দম্পতির জমিতে অবস্থিত হওয়ায় এই গাছটির নাম দেয়া হয়েছে অ্যাঞ্জেল ওক ট্রি। ১৯৮৯ সালে হারিকেন হুগোর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে গত ৩০ বছরে গাছটি নিজে থেকেই সেই ক্ষতি সামলে উঠেছে। ১৯৯১ সাল থেকে ঐতিহ্যবাহী এই ওক গাছ এবং তার সংলগ্ন উদ্যানটি চার্লসটন কাউন্টি কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত হচ্ছে। 


এটির বৈজ্ঞানিক নাম হুরা ক্রেপিটানস। এই জাতীয় গাছগুলো সাধারণত উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিষুবীয় অঞ্চলে জন্মায়। বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন জঙ্গলে এই জাতীয় গাছ বেশি দেখা যায়। বাদামি রঙের মসৃণ কাণ্ডের উপর অসংখ্য কাটা থাকার কারণে এই জাতীয় গাছ খুব সহজে শনাক্ত করা যায়। এই কাঁটাগুলোর ভিতর বিষ থাকায় এর আঁচড়ে তীব্র চুলকানি শুরু হতে পারে। 


এমন কণ্টক আবৃত থাকায় বানরজাতীয় প্রাণী গাছে উঠতে পারে না। স্থানীয়রা তাই এর নাম দিয়েছেন 'মানকি নো ক্লাইম্ব ট্রি' অর্থাৎ যে গাছে বানর চড়তে পারে না। প্রায় ৬০ মিটার বা ২০০ ফুট লম্বা এই গাছের মিষ্টি কুমড়া সদৃশ ফলগুলো পরিপক্ক হওয়ার পর সজোরে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের প্রভাবে ফলের ভিতর থাকা বীজগুলো ৩০ মিটার থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এই গাছের আরেকটি নাম 'ডাইনামাইট গাছ'। অপরিপক্ক অবস্থায় এই ফল দিয়ে স্থানীয়রা কলমদানি তৈরি করেন। 


এবারে কোনো একক গাছের বদলে অদ্ভুত একটি জঙ্গলের কথা জানাবো। আফ্রিকার দেশ নামিবিয়ার মরু এলাকায় অবস্থিত ক্যামেল থ্রন নামক এই মৃত গাছের জঙ্গলটি দেখলে সিনেমার ভুতুড়ে জঙ্গলের কথা মনে পড়ে যায়। মৃত এই ক্যামেল থ্রন প্রজাতির গাছগুলোর জন্ম হয়েছিল প্রায় ৯০০ বছর আগে।


আনুমানিক এক হাজার বছর আগে এই এলাকায় অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা হয়। তখন এখানে জলাবদ্ধতার সুযোগে এই ক্যামেল থ্রন গাছগুলোর জন্ম হয়েছিল। কিন্তু ১০০ বছরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই এলাকা আবারো মরুভূমিতে পরিণত হয়। ফলে গাছগুলো মরে যায়। এরপর থেকে এই ভুতুড়ে জঙ্গলটি এখানেই এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। 


হাতপাখা আকৃতির এই গাছটি মূলত মাদাগাস্কার দ্বীপে দেখা যায়। তবে ইদানিং বিশ্বের অন্যান্য দেশের বাগানেও এই গাছ রোপন করা হয়। প্রথম দর্শনে এই গাছটি দেখে মনে হবে কোনো আত্মভোলা শিল্পী যেন খেজুর গাছের কাণ্ডের তাল গাছের ডাল বসিয়ে দিয়েছে। সেই ডালে জন্মানো পাতাগুলো আবার কলা পাতার মতো দেখতে। মাদাগাস্কারের মানুষ এই গাছের নাম দিয়েছেন ট্রাভেলার্স পাম। কেননা এই গাছগুলো ট্রাভেলার্স বা ভ্রমণকারীদের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদান করে। 


প্রথমত এই গাছের একেকটি ডালের গোড়ায় কয়েক লিটার জল সঞ্চিত থাকে। বৃষ্টি প্রবণ এলাকায় জন্মানো গাছগুলো তাদের ডালের গোড়ায় বৃষ্টির জল ধরে রাখে। তৃষ্ণার্ত ভ্রমণকারীরা প্রয়োজনে তা ব্যবহার করে তাদের জলের চাহিদা পূরণ করতে পারেন। এছাড়া এই গাছের সারিবদ্ধ ডালগুলো সাধারণত পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে বিন্যস্ত থাকে। ফলে গাছ দিকভ্রান্ত ভ্রমণকারীরা দিক নির্ণয়ের জন্য কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। এই গাছগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম রাভেনালা মাদাগাস্কারিয়েন্সিস। 


এই গাছটি দেখতে খুবই অদ্ভুত। ইয়েমেনের অন্তর্ভুক্ত সুকাত্রা দ্বীপপুঞ্জে জন্মানো এই গাছগুলোর কাণ্ড থেকে রক্ত লাল রঙের এক ধরনের নির্যাস বের হয়। সেই নির্যাস গর্ভপাতের প্রভাবক হিসেবে ব্যবহার করেন স্থানীয়রা। ওষুধে ব্যবহারের পাশাপাশি রং, সুগন্ধি, বার্নিশ এবং লিপস্টিকের মতো প্রসাধনসামগ্রীর উৎপাদনে এই ড্রাগনস ব্লাড পদার্থটি ব্যবহার করা হয়। চিরসবুজ এই ড্রাগনস ব্লাড গাছগুলো দেখতে খোলা ছাতার মতো। 


আনুমানিক ৫০ লাখ বছর আগে উত্তর আফ্রিকার মরক্কো থেকে শুরু করে আরব উপদ্বীপের ইয়েমেন পর্যন্ত এক বিশাল ক্রান্তীয় জঙ্গলের অস্তিত্ব ছিল। আদিম সেই জঙ্গলের অধিকাংশ গাছই ছিল এই ড্রাগনস ব্লাড জাতীয়। কালের পরিক্রমায় পৃথিবীর এই অঞ্চলটি মরু প্রধান হয়ে পড়ায় এই জাতীয় গাছের অস্তিত্ব বর্তমানে হুমকির মুখে পড়েছে। এ জাতীয় গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ড্রেসিনা সিনাবারি। 


বৃহত্তম জীবের খেতাবটি প্যান্ডো বা ট্রেম্বলিং জায়ান্ট নামে পরিচিত একটি অ্যাসপেন বনের দখলে রয়েছে। ভাবছেন, একটি বন কীভাবে একক জীব হিসেবে গণ্য হয়? এর কারণ বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের ইউটা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত এই বনের অ্যাসপেন গাছগুলোর জিন পরীক্ষা করে জানতে পারেন, এই বনের প্রতিটি গাছ একে অপরের ক্লোন হিসেবে বেড়ে উঠেছে। অর্থাৎ এই বনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় ৪০ হাজার গাছের ডিএনএ হুবহু একই রকম। 


সব মিলিয়ে প্যান্ডোর আয়তন ১০৮ একর বা প্রায় সাড়ে চার লাখ বর্গ মিটার। তার সবগুলো গাছের সম্মিলিত ওজন আনুমানিক ৬০ লাখ বা ছয় হাজার টন। শুধু বিশ্বের বৃহত্তম জীবই না, এই অ্যাসপেন বনটি একই সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সী জীব। একেকটি অ্যাসপেন গাছ ১০০ থেকে দেড়শো বছরের বেশি বাঁচে না। কিন্তু এই বনের পুরোটা জুড়ে বিস্তৃত শেকড় ব্যবস্থার বয়স ১৪ হাজার বছরের বেশি। 


অ্যাসপেন বনটি গত শতকের শুরু থেকে ইউটা অঙ্গরাজ্যের ফিশ লেক ন্যাশনাল পার্কের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। ন্যাশনাল পার্কটির ওয়েবসাইটে এই বনের বয়স ৮০ হাজার বছর উল্লেখ করা হলেও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা এই দাবির সঙ্গে একমত নন। সম্প্রতি দাবানল এবং এক জাতীয় ছত্রাকের সংক্রমণে এই বনে বেশ কিছু অ্যাসপেন গাছ মরে যাচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় অ্যাসপেন অ্যালায়েন্স নামক একটি সংগঠন ছত্রাক সংক্রমণের প্রতিষেধক আবিষ্কারে বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। 


রেইনবো ইউক্যালিপটাস গাছ


এই গাছটি বর্ণিল দেখে এটির নাম রেইনবো ইউক্যালিপটাস বা রংধনু গাছ। এই জাতীয় গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ইউক্যালিপটাস ডিগ্লুপ্টা। পৃথিবীতে ৭০০ এর বেশি ইউক্যালিপটাস প্রজাতির গাছ রয়েছে। এর মধ্যেই রংধনু ইউক্যালিপটাসই কেবল অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায় না। প্রাকৃতিকভাবে এই জাতীয় ইউক্যালিপটাস ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং পাপুয়া নিউগিনির রেইনফরেস্টে জন্মে থাকে। তবে এ কাণ্ডের সৌন্দর্য এবং সুগন্ধির কারণে সম্প্রতি এই জাতীয় ইউক্যালিপটাস পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও রোপণ শুরু হয়েছে। 


এই জাতীয় ইউক্যালিপটাস সাধারণত ৬০ থেকে ৭৫ মিটার বা ২০০ থেকে আড়াইশো ফুট লম্বা হয়ে থাকে। এর নামের সঙ্গে রংধনু বিশেষণ সংযুক্ত হবার কারণ এমনিতেই মসৃণ বাঁকলের রঙে কমলা আভা যুক্ত থাকে। তবে নিজে থেকেই গাছের বিভিন্ন স্থানে এই বাঁকল খসে ভিতরের কাণ্ড বেরিয়ে আসে। এই অংশগুলোর রং হালকা সবুজ, গাঢ় লাল এবং কমলা থেকে শুরু করে ধূসর, বাদামি এবং বেগুনি হতে পারে। সব মিলিয়ে এই গাছগুলোর কাণ্ডটা দেখে রংধনুর কথাই মনে পড়ে যায়।

1 টি মন্তব্য:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.